Skip to main content
mete
এতটা কোনোদিন আসে না। আজ কি খেয়াল হল কে জানে? কিছু ভাবছিল কিনা নিজেও মনে করতে পারল না। আর মনে করেই বা কি হবে? ভাবনা তো ভাবনাই। নদীর মত। বয়েই যাচ্ছে। বয়েই যাচ্ছে। ওহ... নদী বলতে মনে পড়ল, এবারের ঘাসগুলো ভীষণ মিষ্টি আর কচি। কিন্তু লালি যায় বলে তার আর যেতে ইচ্ছা করে না। বুধন যখন তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোয়, মাঠ পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা নেয়, বাঁদিকেই পড়ে নদীটা, লালি একা একা ঘাস খাচ্ছে। রোজই দেখে। চলাটা থেমে যায়। বুধন ধাতানি দেয়, আবার তাড়াতাড়ি চলে আসে। ছাগলের হৃদয় হয়, এটা মানুষের বোঝার কথা নয়। তাদের জাতের মেটেকেই চিনেছে, হৃদয়ের মূল্য আর কে বোঝে?

ভুতো আবার খাওয়ায় মন দেয়। তার চকচকে কালো গা মাছি বা এটা-ওটা কোনো পোকা বসলেই কেঁপে কেঁপে ওঠে। হঠাৎ মেঘ ডাকার আওয়াজ শুনে ভুতো আকাশের দিকে তাকালো। কি সর্বনাশ, এত মেঘ করল কখন? এতো তার গায়ের মত কালচে রং! চারদিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই। এদিকে এখনি বৃষ্টি শুরু হবে, বুঝতেই পারছে। ভুতো এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ভাঙা শিবমন্দির দেখতে পেল। তার উপরে ছাউনি দেওয়া বড় অশ্বত্থ গাছ। ভুতো দৌড় লাগালো। আর ভুতোকে ধরার জন্যে যেন হুড়মুড় করে চলে এলো বৃষ্টি। বাপ রে কি দানার সাইজ! যেন ঢিল ছুঁড়ে মারছে কেউ।

মন্দিরটায় ঢুকেই ভুতো দেখল একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। তাকে দেখেই হিসহিস করে দু'বার আপত্তি জানালো। ভুতো বলল, আরে আমি বৃষ্টি থামলেই চলে যাব। সামনে এ পাথরটা কিসের? সাপ বলল, শিবের। তুমি ওদিকেই থাকো, এদিকে এসো না। তোমার গায়ে বড় বিশ্রী গন্ধ। তুমি কি পাঁঠা? ভুতো বলল, তা বলতে পারো। কিন্তু তুমি ওরকম জড়িয়ে মড়িয়ে শুয়ে কেন? শরীর খারাপ? সাপ বলল, না রে ভাই, বাতের যন্ত্রণা। যা হোক, তুমি ওদিকেই থাকো। আর ওই গুটলি গুটলি হাগলে বাইরে গিয়ে হেগো বাপু, ওতেও ভীষণ গন্ধ।

ভুতো কোনো উত্তর না দিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগল। বেশি, বেশি। একটু বিষ আছে বলে দেমাক দেখো! তার শিং নেই? আছে তো। তা বলে অমন দেমাক আছে? নেই। ভুতো বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনের মধ্যে আবার এটা-সেটা ভাবছে। বিশেষ করে লালির কথা। যদি লালি এদিকটায় আসত। যদি এই মন্দিরের চাতালে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। লালির মালিক বড় পাজি। মেয়েটাকে খেতে পর্যন্ত একটু ভালো মাঠে নিয়ে আসতে পারে না। নদীর পাড়ের ওই ঘাস, সে যতই মিষ্টি হোক, আরে কতটুকু জন্মায়? আর অর্ধেক তো গরুগুলোতেই খেয়ে যায়। একটা বড় মাঠে এনে ছেড়ে দিলে কি হয়? ভুতো আবার স্বপ্ন দেখছে। লালি আর সে সংসার পেতেছে। তাদের পাঁচটা ছেলেমেয়ে হয়েছে। কয়েকটা কালো তার মত, আর কয়েকটা খয়েরি লালির মত।

খুব জোরে বাজ পড়ল একটা। সাপটা চমকে উঠে বলল, শুনলে? লোকে বলে আমরা নাকি শুনতে পাই না। কি জোরে কেঁপে উঠল মন্দিরটা! তুমি আরেকটু ভিতরের দিকে এসে দাঁড়াও, নইলে বাজ পড়েই হয়তো মরে গেলে আর লোকে কেটে খেয়ে নিল।

ভুতো একটু ভিতরের দিক ঘেঁষে দাঁড়ালো। অনেকগুলো চামচিকে মন্দিরটার ছাদে কিচমিচ করছে। ভুতো মাথা তুলে তাকালো। হঠাৎ একটা চামচিকে উড়ে এসে, মন্দিরের মধ্যে ঝোলা একটা তার ধরে ঝুলে বলল, এই ভুতোদা, তোমার কি লালিকে সত্যিই পছন্দ?

ভুতো আঁতকে উঠে বলল, হ্যাঁ... মানে... তুমি জানলে কি করে?

চামচিকে বলল, আরে লালিই বলেছে। ওকে যেখানে রাতে রাখে, আমাদের মাঝেমধ্যে ওদিকে যেতে হয় তো। আমার মেজোমাসি ওদের বাড়ির পাশের আমগাছে থাকে। তো কথায় কথায় লালি একদিন বলছিল।

সাপটা বলল, এই লালি কে?

ভুতো বলল, সে আছে একজন। তারপর বেশ উদগ্রীব হয়েই বলল, ও কি ভাবে আমার ব্যপারে? রাজি?

আর রাজি! ওর বায়না হয়ে গেছে তো! আজ রাত্তিরেই কাটা হবে। ওই তোমাদের গ্রামের মুকুল মুখুজ্জেদের বাড়ির ছেলেটা আছে না, ওরা বন্ধুরা মিলে আজ পিকনিক করবে। তা সস্তায় পেয়েছে নাকি বলল।

ভুতোর সব অন্ধকার হয়ে গেল। তার মানে কি, লালিকে আজকেই কেটে খেয়ে ফেলবে? তাও কি হয়? হবে নাই বা কেন? হামেশাই হচ্ছে। ভুতো বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটা দিল। প্রবলবেগে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড় হচ্ছে। বাজ পড়ছে। তাও ভুতো হাঁটছে। দুপুরের আলো মেঘের অন্ধকারে যেন মনে হচ্ছে এখনই সন্ধ্যে নামবে। ভুতোর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা যদি এমন হয় সে নিজে ওদের কাছে ধরা দেয়। যদি তাকেই কেটে খেয়ে নেয়, তবে তো আর লালিকে চাইবে না ওরা। কারণ তার চেহারা লালির চাইতে অনেক বেশি পুষ্ট। তার মাংসের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। মনে মনে সে তাই ঠিক করে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পর গ্রামের নদীর পাশে একটা ঝোপে অপেক্ষা করতে লাগল অন্ধকার হওয়ার। নইলে বুধন দেখলেই তাকে ধরে নিয়ে যাবে যে!

দেখতে দেখতে অন্ধকার হল। ভুতো গুটিগুটি পায়ে মুকুলদের বাড়ি ঢুকতেই টের পেল বুধনের গলা। আরো অনেকে মিলে চেঁচামেচি করছে। এত লোক তো গ্রামের নয়। ভুতো মুকুলদের বাড়ির পিছনের দিকে যেতেই দেখল লালি বাঁধা আছে। লালি বৃষ্টিভেজা কাদামাটিতে গা ডুবিয়ে ঘুমাচ্ছে।

ভুতো তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। লালি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো। লালির চোখের দিকে তাকিয়ে কান্না পেল ভুতোর। ইচ্ছা হচ্ছে লালিকে নিয়ে এখনই চলে যায়, কিন্তু কদ্দূর যাবে? এদের ধরতে বেশিক্ষণ লাগবেও না। ভুতো ধীরে ধীরে লালির দিকে এগিয়ে এলো। লালি কিছু বলল না। লালির গালে গাল ঠেকালো। লালি তাও কিছু বলল না। ভুতো লালিকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ চারদিকে হইহই শব্দ। সবাই মিলে অনেক কথা বলছে। মোদ্দা কথাটা বুঝতে ভুতোর একটু সময় লাগল। মোদ্দা কথাটা হল, এই গ্রামের প্রচারের জন্য আজ নেতা এসেছেন শহর থেকে। তিনি ভীষণ ধার্মিক। নিরামিষ পাঁঠার ঝোল ছাড়া কিচ্ছু খান না। তাই বিকেলেই বুধনের পাঁঠাটাকে বায়না করেছে পাড়ার ছেলেরা। পাড়ার ছেলেরা বুধনকে বলেছে, ভোটের আগে এরকম অনেক পাঁঠার বলি হয়। তাই বেশি দাম না চড়াতে। এ দেশের কাজ। বুধন তাই অল্প টাকাতেই নাকি রাজি হয়ে গেছে।

ভুতো সব শুনে লালির দিকে তাকালো। লালির কানে কানে বলল, তুই পরের জন্মে কি হবি বল, চামচিকে না সাপ? লালি লজ্জা পেল, ভুতোর কানে কানে বলল, নদী।