সৌরভ ভট্টাচার্য
11 March 2020
ভীষণ শক্ত ভাষায় কবিতা লিখতে গিয়ে নবারুণ খিস্তি ব্যবহার করেছে। বাঙলা ভাষা, সংস্কৃতিকে 'imbecile' বলেছে। শিল্প সাহিত্য জুড়ে Lumpen দের রাজত্ব বলেছে।
এ সবই কি ভুল? চারদিকে যা চলছে, যা ঘটছে, এই কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? এত সেনসরশিপ চারদিকে, এত সংস্কৃতির ঢক্কানিনাদ, এত বিপ্লব এত চেতনার মধ্যেও দিল্লী নগ্ন হয়ে দাঁড়ালো তো? প্রতিদিন টাকাপয়সার সুরক্ষা, জীবনের সুরক্ষা, জীবিকার সুরক্ষা এক এক পা করে খাদের দিকে এগোচ্ছে তো?
মাঝে মাঝেই মনে হয় বাংলা ভাষায় দীর্ঘদিন যেন কোনো কবিতা পড়িনি। বাংলাভাষায় এমন কোনো কথা যেন অনেকদিন পড়িনি যা পড়লে মনে হয় আমি আমার চিন্তাকে দাঁড়ান দেখতে পেলাম কোনো ল্যাম্পপোস্ট বা গাছের গুঁড়িকে ঠেসান না দিয়ে। এমন কেন হচ্ছে? কেন অস্থির হচ্ছি অথচ বলতে পারছি না আমি অস্থির হচ্ছি। বলতে লজ্জা লাগছে। এত সুখ, এত উৎসব, এত ভালো থাকা চারদিকে। লজ্জা লাগছে। অকারণে এর তার ঘুম ভাঙিয়ে কি লাভ? জেগেও বা তারা কি করবে? কবিতা একদিন আস্থা ছিল, আজ কবিতাগুলোকে ভয় করে। কবিতার বই দেখলে ভয় করে। এত বিকিয়ে যাওয়া ভাষা! ঘেন্না লাগে।
গতকাল মেঘের আস্তরণের মধ্যে ঢাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শাহীনবাগের কথা ভাবছিলাম। সেই কবিতাটার কথা ভাবছিলাম যা একজন বিদেশী উচ্চারণ করেছে বলে আমাদের মিডিয়া উল্লাসে গর্বে ফেটে পড়েছে। কোনো শাহীনবাগের অপরিচিত মহিলা বা পুরুষ বলেছে বলে নয়। বিপ্লবও, প্রতিবাদও এত সেলিব্রিটি নির্ভর এখন।
পলাশ, বসন্ত, প্রেম নয় আসলে। যন্ত্রণা দিচ্ছে দিল্লী। আসলে দিল্লী নয়। আসলে আমার মনের মধ্যে বসে থাকা আতঙ্ক, আশঙ্কা, ভয় - সর্বোপরি একটা অমঙ্গলের ডাক। এ বীজাণু করোনার থেকে ভয়ংকর। কারণ করোনার এক বিজ্ঞান আছে। ধর্মান্ধতার কোনো বিজ্ঞান নেই, মেরুদণ্ডহীনের কোনো নীতি নেই। অথচ সেই ধর্মান্ধ আর মেরুদণ্ডহীন অজস্র মানুষ - কবি, নেতা, নায়ক, পরিচালক, আমলা সেজে ভিড় করে চারদিকে।
আসলে খুব বিভ্রান্ত। করোনার জন্য জন সমাবেশ বন্ধ হল, কিন্তু কেউ বলল না এতগুলো নিরীহ মানুষের ড্রেনে পড়ে থাকা লাশগুলোর জন্য আমরা এবার স্তব্ধ থাকি। কেউ বলল না। সবাই বরং বুঝিয়ে যাচ্ছে সব কিছু ভালো আছে। সব কিছু। আমার এই ফেসবুকের পেজও ভালো লাগছে না, কিন্তু এ কথাগুলো কোথায় লিখব? আমার উঠতে বসতে যে লাশগুলো নর্দমা থেকে উঠে আসছে, তথাকথিত আধুনিক উত্তর ডিজিটাল চন্দ্রাভিলাষী ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজছে তাকে আমি কি উত্তর দেব? হয় রঙ মেখে নিজেকে অপরিচিত করি, নইলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলি, সব মৃত, ফিরে যাও।
ভালো থাকা যাচ্ছে না। এত উৎসব, এত আলো বড্ড ম্লান লাগছে। সব কিছু মিলিয়ে আজ নিজেকে একটা ধর্ষিত লাশ লাগছে। প্রতিদিন যেন ঘর সাজিয়ে বসছি, বুদ্ধিবিবেককে গাভীর মত খাটালে বেঁধে, নির্বোধ লোভ আর উচ্চাশায় নিজের শরীর সাজিয়ে বলছি, ধর্ষণ করো, ভোগ করো আমায়, আমি এই তো সেজে বসে আছি।
আমি হলিউডের জোকারকে খুঁজছি না। প্রতিক্ষণে নিষ্পেষিত হতে হতে ফ্যাতাড়ু আর হার্বার্টের নবারুণ ভট্টাচার্যকে খুঁজছি। তার বিস্ফারিত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আজ প্রথম রবীন্দ্রনাথকে বলতে চাইছি, তুমিও এসো না ক’দিন। আমার ঝাঁটা লাগবে, আমি ঝাঁটা-বালতি খুঁজতে নোংরা গলিতে এসেছি। তুমি প্রজ্ঞাবান। আর আজ চারদিকে প্রজ্ঞাহীন কিছু কবি, যাদের মানসচক্ষে ভবিষ্যতের আলোর দিশা আসার ছিল তারা কৃত্রিম ফুলের বাজারে শৌখিন ভাষায় কেউ ছন্দ মেলাচ্ছে, কেউ উদাস হয়ে ঝুল বারান্দা থেকে দামী মালী দিয়ে কাটা নরম ঘাসের উপর যুগান্তকারী নাটুকে আত্মহত্যার প্লট ভাবছে। এরা আসলে শৌখিন গণিকাবৃত্তিতে নেমেছে অট্টালিকার লোভে। তুমি ফিরে যাও। আমি কিছুক্ষণ নবারুণের কাছে বসি। কিছুই শিখব না, সে জোর আমার নেই। শুধু আমি যে ভালো নেই, এইটুকু আত্মসম্মান রেখে কয়েকটা শ্বাস এই মানুষটার কাছে বসে নিয়ে যাই। তারপর তো সেই ঘরে ফেরা, আছেই।