Skip to main content
মেঘবন্দী


        এ সব কথা শুনতে চাইছ? আজকাল কেউ শুনতে চায় না। আমার বর্ষা? যেদিন প্রথম এই বাড়ির বউ হয়ে আসছি, আষাঢ় মাসের শেষের দিক ছিল, কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি... আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় তখন পাকা রাস্তা কই... না কারেন্ট... আমি তো বিয়ের আগে এরকম কিছু দেখিনি... কি কাদা... কি কাদা... এখানে সেখানে জল জমে... আমার নতুন বেণারসী ভিজে চাপচাপ... শাড়িটা একহাতে ধরে, প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি তুলে, আরেক হাতে ছাতা নিয়ে, পা চেপে চেপে কোনো রকমে হাঁটছি... ভাবছি আর কতদূর রে বাবা... উনি আমার আগে আগে যাচ্ছেন... মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছেন আমি আসতে পারছি কি না... কি জানো আমার ওই শুভদৃষ্টি..... বিয়ের সময় যে শুভদৃষ্টি হল তখন আর তাকালাম কই লজ্জায়......আষাঢ়ের সেই মেঘলা পড়ন্ত বেলাতেই হল আমাদের সত্যিকারের শুভদৃষ্টি... ওনার চোখের ওই কুন্ঠিত উদ্বিগ্নতা... আমার প্রথম প্রেমের অনুভূতি... তখন আমারই বা বয়েস কত হবে... ষোলো... ওনার চব্বিশ...
        বাড়িতে এলাম... কারেন্ট নেই... ওদের বাড়িতে তখনও কারেন্টের লাইন নেওয়া হয়নি... আরো বছরখানেক পরে কারেন্ট এসেছিল। উনি বলেছিলেন, “তোমার খুব অসুবিধা হবে প্রথম প্রথম... ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে, দেখো”।
        ফুলশয্যা, বাইরে তুমুল বৃষ্টি তখন... আমার কান্না পাচ্ছে মায়ের জন্য... বাবার জন্য... ভাইদের জন্য... বাড়ির উঠোনটার জন্য... করবী গাছটার জন্য.... আমার খুব রাগ লাগতে লাগল ওনার উপর... যেন উনিই আমাকে ছিনিয়ে এনেছেন আমার যা কিছু নিজের ছিল তার থেকে, আমার সব কিছু থেকে... আমি ওনার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলাম না... ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম। খানিকবাদে উনি চুপ করে গেলেন। বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে বেশ জোরে... মাথার দিকে ছাঁট আসছে মনে হল কোথা থেকে... উঠলাম না... একটু পর ওনার নাক ডাকার আওয়াজ পেলাম... পুরো বাবার মত... আমার ভালো লাগল... অন্যরকম ভালোলাগা... তোমরা যাকে প্রেম বলো ঠিক তা নয়... একটা নিরাপত্তার ওমে যেন ডুবে যেতে লাগলাম... ঘুমিয়ে পড়লাম...
        বিরাটির এই ফ্ল্যাটে এসেছি আমরা ওনার রিট্যায়ারমেন্টের বছর তিনেক আগে। ওনার যে ছবিটা আমার মাথার পিছন দিকের দেওয়ালে ঝোলানো আছে দেখছ, ওটা এই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে তোলা। আমার বর্ষা জিজ্ঞাসা করছিলে না? উনি চলে গেলেন যেদিন সেদিনও এরকম বৃষ্টি হচ্ছিল সকাল থেকে... কি অদ্ভুত সমাপতন না? যেদিন আমায় ওনার সংসারে নিয়ে এলেন সেদিনও ভাসিয়ে আনলেন, যেদিন আমায় একলা রেখে গেলেন সেদিনও চারদিকে জল থইথই... কুকুর বেড়ালও রাস্তায় নামেনি সেদিন জানো, ওনারই চলে যেতে হল... নার্সিং হোম থেকে ফোন এলো যখন তখন সামনে জল জমে গাড়িঘোড়া সব আটকে... বাবু দু'দিন হল রায়পুর থেকে ফিরেছে... তখনও ওর বিয়ে হয়নি...
        আমার চশমাটা বোধহয় ওই টেবিলে আছে। থাক। কি আর দেখার এখন। তুমি যে সময়ে নিয়ে গেছ আমায় সে সময়কে বিনা চশমাতেই দেখি... রোজ দেখি... আমি যথেষ্ট সুন্দরী ছিলাম জানো... আমার বোনেদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে সুন্দরী... গর্ব ছিল আমার... এই লম্বা হাঁটু অবধি চুল... এমন বর্ষায় শুকাতো নাকি? তোমরা ছেলেরা ওসব বুঝবে না... ”দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ”... কবি তো লিখেই ক্ষান্ত দিলেন, কিন্তু সেই ঘন কালো দীর্ঘ কেশ সামলানোর যে কি ঝক্কি এই স্যাঁতস্যাঁতে দিনগুলোতে... চুলে গন্ধ হয়ে যেত... তখন তো আর এখনকার মনে চুলের সেন্ট বেরোয়নি বাবা... তবে আমার গর্ব ছিল... নিজের রূপ নিয়ে... উনি দারুণ দারুণ শাড়ি আনতেন কলকাতায় গেলেই... আমি সাজলে খুব খুশী... পাশে সুন্দরী বউ নিয়ে হাঁটার একটা গর্ব কোন পুরুষের না হয়... বিয়ে তো করলি না ছোঁড়া... করলে বুঝতিস...
        বাবু যেদিন প্রথম চাকরিটা পেল, পুণে চলে গেল, সেদিন আমি বুঝলাম আমাদের চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে... তবে ওনার চামড়াটা যেন বেশি কুঁচকে গেছিল... খুব সুগার ছিল, তাতেই কিনা জানি না... উনি আমায় ঠাট্টা করে বলতেন উনি যখন চাকরিতে ঢুকেছিলেন আমি নাকি তখনও জন্মাইনি... তাই নাকি আমার তখনও ভরা যৌবন... কথার ছিরি দেখো... আমি বলতুম... তা তুমি যদি পেট থেকে পড়েই চাকরি করতে যাও আমি কি করতে পারি বলো... আসলে ওনাদের খুব অভাবের সংসার ছিল... বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন আমার শাশুড়ি শ্বশুর...
        জানো আমার শাশুড়ি একটা মানুষ ছিলেন বটে... অনেক ভাগ্য করলে একটা মেয়ে অমন শাশুড়ি পায়... প্রথম প্রথম তো উনি অফিস থেকে ফিরলেই আমার তো বিরক্ত লাগত... উফ্ কত কাজ... জল দাও রে... খাবার দাও রে... আমার শাশুড়ির সাথে গল্প করে সারাদিন কাটত... আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরলেই বলতেন... "যাও বউমা, আমার ছেলেটা এসে গেছে..." অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হত, শুধুই কর্তব্যের খাতিরে..... তারপর ধীরে ধীরে কবে থেকে যে আমি ওনার ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম মনে পড়ে না... সেটা অজান্তেই হয়েছিল...
        এমন বর্ষার দিনে আমি আর মা, মানে আমার শাশুড়ি, প্রায়ই দুপুরে খিচুড়ি চাপিয়ে দিতাম... বাবা বলতেন, "আচ্ছা বউ আর বউমা হয়েছে তো গো... এতো সারা বর্ষাকাল বাড়িটাকে আশ্রম বানিয়ে রেখে দিল"। মা মুচকি হাসতেন আমার দিকে তাকিয়ে... তারপর পাতে যেই পোস্তর বড়া পড়ত... অমনি বাবার মুখে হাসি দেখে কে...
        দুপুরে মা আমাকে রামায়ণ বা মহাভারত পড়ে শোনাতে বলতেন... কয়েক পাতা পড়ার পরই শুরু করতেন গল্প... "জানো বউমা, আমার যখন বিয়ে হল উনি তখন তেমন কিছু একটা করতেন না, ওই পুজো-আচ্ছা করে যেটুকু, ওতেই বেশ চলে যেত আমাদের"... ওনার স্বামীকে নিয়ে ওনার খুব গর্ব ছিল... তা জানো গর্ব হওয়ারই কথা... মা লিখতে পড়তে জানতেন না বলে আমার শ্বশুর মশায় লুকিয়ে লুকিয়ে বর্ণপরিচয়, কিশলয়, ধারাপাত এইসব কিনে নিয়ে আসতেন... মাকে নিজের হাতে ধরে লেখাপড়া শেখান... পরে পাড়ার লাইব্রেরী হয় যখন তখন মায়ের নামে একটা কার্ডও বানিয়ে দেন... মাকে বলতে শুনেছি অনেকবার জানো... ”কি জানো বউমা... রামায়ণ মহাভারত তো যাত্রা থিয়েটার কি এর ওর মুখে শুনে জানাই হয়ে যায়... কিন্তু পড়তে না পারলে আমার সারা জীবন শরৎচন্দ্র পড়া হয়ে উঠত না! ভাবলে আমার মনটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায় বউমা... এমন করে কোনো পুরুষ মেয়েদের কথা জানে কি করে বউমা”... বলতে বলতে ওনার গলা বুজে আসত... চোখ সজল হত... ওনার গল্প শুনতে শুনতে আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যেতাম মনে মনে... স্থান কালের কত পার্থক্য, কিন্তু গল্পগুলো কত একরকম জানো...
        রাতে যখন একা শুয়ে থাকি... বয়েস হলে ঘুম কমে জানো তো... এই বৃষ্টির আওয়াজে পুরোনো দিনগুলো ভেসে আসে... সেই একবার কত সালে যেন বন্যা হল... সাতাত্তরে না আটাত্তরে... আটাত্তরেই না? হ্যাঁ...... উনি প্রায় আটদিন অফিসে যেতে পারেননি জানো... আমরা তো হানিমুনে যাইনি... ওই আমার হানিমুন ছিল... বাবু'র তখন বয়েস তিন.... সারাদিন ঘুরে ফিরে ওনার কাছাকাছি... মা বুঝতেন... চোখে হাসতেন... বলতেন... মেঘবন্দী হয়েছে বউমা... লজ্জা পেতাম...

        হ্যাঁ এখন এই ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। আমার শাশুড়ির গোবর নিঙানো উঠোন, আমার সাধের ফুলের বাগান কিছুই নেই বাবা... যা আছে এই সামনের ঝুলবারান্দায় রাখা কয়েকটা ফুলের টব... রাধামাধবের পুজোর কয়েকটা ফুল ওই জুগিয়ে যায়... আমার উঠোন বলতে ওই... ওরাই বর্ষায় ভেজে... শান্তিনিকেতন বৃন্দাবন যাই বলো... ওই কয়েকটা টবে ঘেরা আমার ঝুল বারান্দাই... ইলেকট্রিক তারে জলের বিন্দু জমে... রাস্তার মোড়ে ওই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ... ঝড়ে ওই একা পাগলের মত হয়ে ওঠে এই ইট-কাঠ ঘেরা শক্ত ঘরবাড়ির মাঝে... আমি তাকিয়ে দেখি... কত রঙের ছাতা... কত রকমের বর্ষাতি... আমাদের সময়ে তো এত মেয়ে কাজে যেত না... এত রকম পোশাকও দেখিনি তাই... ভালো লাগে... মনটা সতেজ হয়ে ওঠে... নানা অপরিচিতের মধ্যে আবার পরিচিত হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে... বাঁচতে সাধ যায় আরো....
        দেখো তো রাস্তায় জল জমেছে কিনা... রান্নার মেয়েটা এত দেরি করছে কেন... ওর টালির বাড়ি... ফুটো হয়ে জল ঢুকছে বলছিল... ওর মেয়েটার আবার জ্বর... আরেকটু দেখি নইলে ভাতে ভাত চাপিয়ে দেব... না আজ বরং খিচুড়ি হোক... তুমি খেয়ে যেয়ো...

[ছবিঃ সুমন]