সারা গায়ে কাদা ছোপ ছোপ, ভূষণ এসে দাওয়ায় বসল। ভূষণ নাপিতের কাজ করত। এখন চলে না। গ্রামে নতুন সাজসরঞ্জামের সেলুন খুলেছে, আর না হোক চারটে। এখন আর রাস্তার ধারে বসে কে চুল কাটাবে। তার ঠাকুরদার পিঁড়ে, কাঁচি, কলপের বাটি, ব্রাশ --- সব খাটের নীচে ট্রাঙ্কে জমা।
ভূষণ মাটি কাটার কাজ করছে মুখার্জীদের বাড়ি। নতুন বাগান করবে। ভূষণের হাতে লাগানো গাছ নাকি সহজে মরে না। ভূষণ বিশ্বাস করে। গ্রামে যে বার 'ম্যালোরি' হল, গ্রামের কতগুলো বাচ্চা মরল, তার চারটেই টিকে রইল। মনোরমা পাশের বাড়ির ছোটো ছেলেটাকে কোলে করে নিয়ে এসে বলল, তুমি এত তাড়াতাড়ি? শরীর ঠিক আছে তো?
ভূষণ দাওয়ায় শুয়ে পড়ল। কিছু উত্তর না দিয়ে ছাওনির দিকে তাকিয়ে রইল। ভূষণের বাড়িতে সে আর মনোরমা ছাড়া কেউ নেই। সব মামাবাড়ি গেছে, শ্রাবণের মেলায়, বসিরহাটের ওদিকে। মনোরমা বাচ্চাটাকে উঠোনে বসিয়ে ভূষণের পাশে বসে কপালে হাত দিল। ঘড়ি দেখল, সাড়ে এগারোটা প্রায়। ভূষণ উপুড় হয়ে শুয়ে পা দুটোকে পিঠের দিকে ভাঁজ করে দোলাতে লাগল। মনোরমা কিছু না বলে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল, তুমি শোও, আমি পুকুরে নেয়ে আসছি। কিচ্ছু রাঁধিনি, মুড়ি বাদাম খেয়ে কাটিয়ে দেব ভেবেছিলাম, তুমিও নেই....
ভূষণ শুনল কি শুনল না বলতে পারি না, ঘুমিয়ে পড়ল। মনোরমা স্নান সেরে এসে দেখে ভূষণ অঘোরে ঘুমিয়ে। মনোরমা ভাত আর আলুসিদ্ধ করে ফেলল। দুটো থালায় বেড়ে ভূষণকে ডাকতে গিয়ে দেখে ভূষণ নেই।
এটা ১৯৮২ সালের কথা। ২০১৩-র জুন মাস। মনোরমা বড় ছেলে আর তার বউয়ের সাথে কেদারনাথ বেড়াতে গেছে। যেদিন পৌঁছিয়েছে সেদিন থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি। মনোরমার গুরুভাইয়েরা সব এসেছে রাণাঘাটের আশ্রম থেকে। সবাই একটা ধর্মশালায় উঠেছে। পরের দিন পূজো দেওয়ার পর থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। তাদের পরেরদিন রওনা দেওয়ার কথা। কিন্তু পিছল রাস্তায় নামতে গিয়ে তাদের এক গুরুভাইয়ের পড়ে পা মচকালো, আরেকজনের মাথা ফাটল। সবাই ঠিক করল, ক'দিন পরে নামলেই হবে।
মাঝরাতে হঠাৎ ভূমিকম্পের মত মেঝে কেঁপে উঠল। মনোরমা উঠে দাঁড়াবার আগেই তার বুক অবধি জল। চারদিক অন্ধকারে লোকজনের চীৎকার, সে কোনদিকে যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, শ্বাসকষ্টটা বাড়ছে, ইনহেলার কই? ছেলেটা কই? হঠাৎ তার হাতটা কে যেন চেপে ধরে তাকে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। ধর্মশালার বাইরে এসে জটা, দাড়ি, ঝুঁকে পড়া শরীরটা... বোঝার আগেই বীভৎস জোরে একটা আওয়াজ কেদারের মন্দিরের উপরের দিক থেকে হল। খানিক বাদেই বিশাল জলপ্রপাত মন্দিরের উপর আছড়ে পড়তে দেখল। মনোরমা একটা ছোটো পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে নিজেকে কোনোমতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মনে হল কে যেন তাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল, নীচে শুধু জল আর জল। সাথে মানুষের আর্তনাদ।
একটা দুলুনিতে তার ঘোর ভাঙল। তাকে আর্মির হেলিকপ্টারে তোলা হচ্ছে। মনোরমা আবার জ্ঞান হারালো। তাকে দেরাদুন থেকে নিতে গিয়েছিল তার ছোটোছেলে। বড়টা আর তার বউ আর ফেরেনি।
বাড়ি ফিরে ক'দিন পর তার আলমারি থেকে একটা চিঠি বার করল।
মনো,
সেদিন কি হয়েছিল আমার আমি আজও জানি না। শুধু জানি সংসার বিষিয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল আমি আর পারছি না, এভাবে চললে আমায় আত্মহত্যা করতে হবে।
আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে লিভারে। আমি কেদারনাথে একটা আশ্রমে আছি। আমার দিন প্রায় হাতে গোনা। তুমি এ চিঠি পাবে কিনা জানি না। যদি পাও, উত্তর দিতে হবে না। পারলে এসো একবার। আমিই যেতে পারতাম, কিন্তু রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে চাই না মনো, মহাদেবের পায়েই শেষ হব। শুধু একটাই ইচ্ছা, তোমায় যদি একটাবার দেখতে পেতাম।
ইতি, শিবদাস স্বামী
(তোমার ভূষণ)
মনোরমা চিঠিটা আবার লকারে রেখে একটা পোস্টকার্ড নিয়ে খাটে বসল। জানলা খোলা। শ্রাবণের কালো মেঘ পুকুর পাড়ের নারকেল গাছগুলোর মাথায় ছেয়ে এসেছে। ওরা যেন তাকে নিতে এসেছে কেদারের রাস্তায় আবার। ডাকতে এসেছে। কিন্তু তার তো সময় হয়নি। মনোরমা লিখল,
তুমি,
আমার প্রণাম নিও। আমি এসেছিলাম। বড় আর বড়'র বউকে রেখে এলাম। তুমি দেখো। আমি আসব, ক'দিন যাক।
ইতি, তোমার মনো