Skip to main content

আচ্ছা, আমি কুসুম ঠাকুমার গল্প কি বলব? একটা দরমার বেড়া দেওয়া ঘর। ছাদ বলতে টালি। টালির কয়েকটা আবার ভাঙা। একটা জানলা মাঠের দিকে। একটা জানলা রাস্তার দিকে। ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা খাট। খাটের উপর একটা পাতলা তোষক। একটা তেলচিটে মাথার বালিশ। খাটের পাশে একটা কুঁজো। তার মাথায় টুপির মত রাখা একটা স্টিলের গ্লাস। দেওয়ালে ঝুলছে চার বছরের আগের একটা ক্যালেন্ডার। কৃষ্ণের ছবি, ভুল বললাম, গোপালের মাখন খাওয়ার ছবি আছে বলে ঠাকুমা ফেলেনি। একটা আলনা উত্তর দিকে রাখা। কয়েকটা সাদা শাড়ি। গামছা। বিছানার চাদর দুটো। বাড়ির সামনে একটা ছোটো ঘর। ঠাকুমার ছাগলগুলো থাকে। দুটো বড় ছাগল। তিনটে বাচ্চা ছাগল। ঠাকুমা দু’বেলা ছাগল চরাতে মাঠে যায়। শাকপাতা যা পায় নিয়ে আসে। বেলায় একবাড়ি বাসন মাজে, কাপড় কাচে। এইতেই চলে যায়।

তো আমি এই ঠাকুমাকে নিয়ে কি গল্প বলব? ঠাকুমার জীবনের ইতিহাসও তেমন কিছু নয়। বিয়ে হয়েছিল। স্বামী সাধু হয়ে গেল। ঠাকুমা না বিধবা না সধবা হল। তারপর চব্বিশ বছর পর থেকে একদিন হঠাৎ করে সাদা শাড়ি পরা শুরু করে দিল। গ্রামে সবাই জিজ্ঞাসা করল, কোনো চিঠি এসেছে? তার এসেছে? স্বপ্নে দেখেছ? কেউ এয়েচিল খবর দিতে? ঠাকুমা সবাইকে বলল, হ্যাঁ। গ্রামের লোকে অবাক হল। একজন মানুষের মারা যাওয়ার খবর এতভাবে আসে? তারে, চিঠিতে, স্বপ্নে, লোকের মাধ্যমে... ধুর…, ও বুড়ির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওদিকে কেউ কেউ কয়েকদিন শ্রাদ্ধ বা ভাণ্ডারা যাই বলো, খাওয়ার লোভে ঘুরঘুর করতে লাগল বুড়ির কাছে। “ও ঠাকুমা খাওয়াবা না?” সারাদিন এ, ও বলতে লাগল। ঠাকুমা গ্রামের কয়েকজনকে ডেকে কি খাওয়ালো কে জানে, গ্রামের পুকুরের জল প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল লোকের হেগে হেগে। সবাই বলল, বুড়ি ডাইনি হয়ে গেছে।

কুসুম ঠাকুমা হল ডাইনি ঠাকুমা। লোকে এদিকে আর মাড়ায় না। যার বাড়ি কাজ করে তারা অবশ্য এ সব মানে না। একজন হেড মাস্টার। তার তিনকুলে কেউ নেই। তার বাড়ি কাজ করে ঠাকুমা।

এখন এই ঠাকুমার গল্প লিখবে বলে আমার কলম সেজেগুজে বসল। কালির অভাব নেই, কিন্তু কথা কই? তো আমি কথা খুঁজতে একদিন দুপুরে গেলাম সেই ঠাকুমার বাড়ি। বেজায় গরম। ঠাকুমা ছাগলগুলোকে নিয়ে নিজের ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। আমি যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, আমার কথা লিখে কি করবে? আমার তো কোনো গল্প নেই।

আমি বললাম, তোমার কোনো দুঃখ, কোনো অভাব, কোনো অভিযোগ কিচ্ছু নেই? ঠাকুমা ভুরু কুঁচকিয়ে ভেবে বলল, আগে ছিল। আমার একটা টিয়া ছিল। সে যেদিন মরে গেল, আমি খুব কেঁদেছিলাম। সেই আমার জীবনে সব চাইতে বড় দুঃখ।

আমি বললাম, আর তোমার বর যে তোমায় ছেড়ে চলে গেল?

ঠাকুমা বলল, সে তো গত জন্মের কথা। সে গেল তো গেল আমি বাঁচলাম। নইলে কে এত ঝক্কি পোয়াতো? আমার হাড়মাস সব এক করে দিত না?

আমি বললাম, বেশ, তোমার জীবনের এমন কোনো সুখ নেই যা নিয়ে গল্প লেখা যায়?

সে বলল, আছে। না আছে না, ছিল। যখন আমার বাতের ব্যথা ছিল না। কি আনন্দে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম। পুকুরে স্নান করতাম। সাঁতার কাটতাম। লাফদড়ি খেলতাম। সে ছিল আমার পরম সুখ। এখন আর কই?

আমি বললাম, আর কোনো সুখ নেই? যা তোমায় এক্কেবারে পাগল করে দিয়েছে?

ঠাকুমা ভেবে বলল, পাগল করা সুখ তো আমার মেঘ দেখলেই হয়। তাই টালি পুরো ছাই না। কয়েকটা ভেঙে দিই। বৃষ্টি টুপটুপ করে ঘরের মধ্যে পড়ে। আমি গামলা পেতে দিই। সেই জল জমে। আকাশ ধোয়া জল। সে কি ফেলনা জিনিস? আমি সেই জলে মুখ ধুই। খাই। কপালে ঘাড়ে বুলাই। ওই যে পশ্চিম আকাশ দেখছ, আজ বিকালে মস্ত মেঘ আসবে। দেখো। মিলিয়ে নিও।

পশ্চিম আকাশে কয়েকটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে দেখলাম। মেঘের নামমাত্র নেই।

বললাম, তুমি ধম্মোকম্মো কিছু করো? দেওয়ালে তো গোপালের ছবি দেখছি।

ঠাকুমা হাসল। আমাদের গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে এমন ছাওয়াল অনেক আছে। আমার ঘরে কেউ আসে না। আমি নাকি খেয়ে ফেলব। তাই একে টাঙিয়ে রেখেছি। এ আমায় ভয় পায় না।

বললাম, ভগবানের কাছে কোনো অভিযোগ নেই তোমার?

ঠাকুমা বলল, না। ভগবান আপন মর্জির মালিক, আমিও নিজের মর্জির মালিক।

কিন্তু তিনি যে তোমায় এত দুঃখ দিলেন, এখনও দিয়ে যাচ্ছেন?

ঠাকুমা বলল, সে আমার ভাগ্য। ভগবান না। ভগবান সে, যাকে অন্ধকারে ডাকা যায়। ভাগ্যকে ডাকা যায়? ভাগ্য পিষে দিয়ে যায়। সহ্য করতে পারলে তো টিকে গেলে, নয় তো নয়।

ছাগল চরাতে যাবে না?

ঠাকুমা বলল, ওই দেখো…

দেখি, সত্যিই আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে এসেছে। ধীরে ধীরে ঝোড়ো হাওয়া দিতে শুরু করে দিল। আমি কিছু বোঝার আগেই হাওয়াটা ঘূর্ণীর মত হয়ে বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর বাড়িটাকে এক ঝটকায় তুলে নিয়ে বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে ঘোরাতে আকাশের মাঝখানের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। ঘরের মধ্যে হুহু করে মেঘ ঢুকে যাচ্ছে। গোপালের ছবি থেকে গোপাল বেরিয়ে এসে ছাগলগুলোর সঙ্গে ঘরময় দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। অনেক নীচে গ্রামের বাড়িঘরগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। আমি খাটের দিকে সরে এসে ভাবছি কি হচ্ছে এসব, হঠাৎ ঠাকুমা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ভয় পাচ্ছ যদি খাটে উঠে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে পারো। আর যদি ভয় না পাও তবে চুপ করে বসো, আমি একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।

দেখতে দেখতে ঠাকুমা ছাগলগুলোকে নিয়ে মেঘের মধ্যে নেমে পড়ল। পিছনে পিছনে যাচ্ছে গোপাল। সবাই মেঘের মধ্যে মিলিয়ে গেল। ঘরটা মেঘের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। এত ঝড়, তবু সবটা স্থির! কি করে হল?

হঠাৎ একদলা মেঘ আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, সবের উত্তর জেনে যাবে তুমি ঘরে বসে বসে? বাইরে এসো, ওদের খুঁজতে যাবে না?