কুরিয়ারের চিঠিগুলো হাতে সন্ধ্যেবেলা বেরোলো বিপ্লব। মেয়েটা উঠানে ব্যাডমিন্টন খেলছে। মেয়েটার হাতটা সকালে পুড়েছে। আলু ভাজতে গিয়ে। নাইনে পড়ে। মেয়ের নাম আলো। মায়ের নাম ছিল সুরমা। আলো যখন ফোরে, চলে গেছে। গোরখপুরে নাকি আছে। নাকি ছেলেও আছে একটা।
আলোকে দেখতে মায়ের মত হয়েছে। সুরমা না, আনন্দীর মত। বিপ্লবের মায়ের মত দেখতে হয়েছে। আলো ঠাকুমাকে দেখেনি। ঠাকুমা ব্রেন ক্যান্সারে মারা গেছে। আলো তখন সদ্য জন্মেছে। একমাস হবে।
কুয়াশা পড়ছে। মেয়েটা চাইছে কাকার বাড়ি যাবে। বিপ্লবের জেঠতুতো ভাই, সুদীপ। রেলে কাজ করে। ওর ছেলে, নবীন, তাকে ফোঁটা দেবে। সঙ্কোচ হয় বিপ্লবের। ওরা বড্ড হ্যাটা করে মেয়েটাকে। মা পালানো গরীব বাপের মেয়ে। সমাজে দামই বা কত পাবে!
চারটে চিঠি আছে। বিপ্লব ভাবছে চায়ের দোকানে বসে, কি করে বোঝাবে আলোকে, যাতে না যেতে চায়। অপমান বোঝে না মেয়েটা। একদম ওর ঠাকুমার মত হয়েছে। যারা অপমান বোঝে না তারা কি বোকা, নাকি খুব ভালো?
একটা শ্যামাপোকা চায়ের মধ্যে পড়ে ছটফট করতে করতে মরে গেল। বোকা! ভাগ্যের হাতে পড়েছিস! বাঁচবি!
চিঠিগুলো নিল। দুটো তো বিয়ের কার্ড। দামী কার্ড। একটা রায়পুর থেকে এসেছে, একটা পুরুলিয়া থেকে।
বিপ্লব কাঁচরাপাড়া স্টেশানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। রেলে কাটা পড়েছে একটা কুকুর। ভাগ্য। আজ খালি কেন এইসব দেখছে! কেন?
দুটো কার্ড দিয়ে দিল। একজনের বাড়ি মিষ্টি দিল। একজনের বাড়ি মুখের দিকেও তাকালো না। আরো দুটো চিঠি এবার। মেয়েটাকে ফোন করবে!
ফোন করল বিপ্লব। দু'বার রিং হয়ে কেটে গেল। কপালে ঘামের বিন্দু জমল। রান্নাঘরে গেল কি? টয়লেটে?
আবার দশ মিনিট বাদে কল করল। কেউ ধরল না। তবে কি এখনও খেলছে? কিন্তু না তো! এত দেরি করে স্বপ্না বাড়ি যাবে না। স্বপ্না পাশের পাড়ায় থাকে।
পাশের বাড়ি ফোন করল। তারাও ফোন ধরল না। ওহ! ওরা তো নেই। মানালি গেছে বেড়াতে।
বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। এই দুটো চিঠি…. এখান থেকে অনেক দূর তো। যাবে? থাক। কিন্তু যদি দরকারি দুটো চিঠি হয়?
কি অসহায় লাগছে! রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপর। চিঠি দুটো…..
বিপ্লবের সাইকেল বাড়ির দিকে ছুটল। না হয় আরো রাতে যাবে চিঠি দিতে। না হয় চাকরি যাবে। কিন্তু চাকরি গেলে?
আধঘন্টা সাইকেল চালিয়ে এলো বাড়ি। অন্ধকার চারদিক। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বিপ্লবের। মেয়েটা….
সবাই ছেড়ে গেছে…. মা, বাবা, ভাই, বউ…
কলিংবেল বাজালো। কেউ সাড়া দিল না। জোরে জোরে চীৎকার করে ডাকতে শুরু করল। পাড়ার দুটো কুকুর ডাকতে ডাকতে চলে এলো। বিপ্লব দরজা ধাক্কা দিল। কেউ নেই। এতক্ষণ খেয়াল করেনি দরজায় তালা দেওয়া।
বিপ্লবের মাথা কাজ করছে না। কাকে ফোন করবে? বসে পড়ল দরজার কাছে। ঠিক তখনই আলো এসে দাঁড়ালো সামনে, তুমি….
বিপ্লব রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে একটা চড় মেরে দিল আলোর গালে… ধরা গলায় বলল, কোথায় গিয়েছিলি… তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি…
আলোর হাতে শক্ত করে কিছু একটা ধরা…..
বিপ্লব কেড়ে নিল আলোর হাত থেকে। গরম লাগল হাতে।
আলো বলল, রুটি তড়কা। আমি আজ রাতে ভাত খাব না। তাই…..
বিপ্লবের মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে জল। গড়াতে দেবে না। এত জেদ। ঠিক মায়ের মত। বিপ্লবের মায়ের মত।
বিপ্লব বলল, আমার দুটো চিঠি বাকি আছে….
আলো বলল, চা খেয়ে যাবে?
বিপ্লব সাইকেলটা হাতে নিয়েছিল, বলল, আয়, দোকানে খেয়ে নেব…. তুই রুটিটা ঘরে রেখে আয়… আমি অপেক্ষা করছি….
বাবা মেয়ে সাইকেলে যাচ্ছে। এক আকাশ তারা। কুয়াশা রাস্তায়। বিপ্লব বলল, লেগেছে?
আলো বলল, এত ভয় পাও কেন… আমি কোথাও যাব না… আমি মায়ের মত নই… ঠাম্মির মত…. তুমিই তো বলো…..
আসলে আলো কারুর মতই নয়। হাসলে শুধু ওর মায়ের মত গালে দুটো টোল পড়ে। বিপ্লবের মায়ের মত না, আলোর মায়ের মত। সুরমার মত। ভয় পায় বিপ্লব। মা'কে দিয়ে আড়াল করতে চায়। বিপ্লবের মা'কে দিয়ে।