Skip to main content
 
 
       চটিটা জুতসই করে পরা না। রোগা মানুষটা লম্বা রডটা ধরে মেঝেটা মুছছে। বালতিতে রডের মুখে জড়ানো কাপড়ের ঝালরটা চুবিয়ে নেওয়ার সময় দেখছে বালতির জলটা ময়লা হল কিনা। হয় না। কারণ দিনে চারবার মেঝে মোছা। মার্বেলগুলোতে অস্পষ্ট ছায়া দেখা যায় হেঁটে যাওয়া মানুষের। মন্তার মনে হয় সব সময় দেখা যায়। মন্দিরে অনেক অশরীরীর বাস। তার মত।
       মন্তার জীবনে পূর্ব অধ্যায় বলে কিছু নেই। বাপ মা ছিল না। নানা ঘাটে ঘুরে এখন এই মন্দিরের দেখাশোনা করে। ব্রাহ্মণ নয়। বেজন্মা আবার ব্রাহ্মণ হয় কি করে? তাই পুজোর অধিকার অসম্ভব। মন্তা নামটাও যেন আকাশবাণীতে পাওয়া। রোগা ফর্সা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া মানুষটার গল্প বলতে কিছু নেই। মন্তা মানে কাজ। কাজের পর কাজ। এখন যেমন সে জামাকাপড় মেলছে। এত মন দিয়ে প্রতিটা কাপড় নিংড়ে নিংড়ে দড়িতে মেলছে দেখলে মনে হয় মন্তার জীবনে এই মুহূর্তটাই পরম। জামাকাপড় মেলা হয়ে গেল। এইবার কলের সামনে দাঁড়িয়ে। জল ভরছে। তিনটে কলসী, চারটে ড্রাম সে একাই ভরবে। ওই যে সবুজ বালতিটা ডান হাতে তুলে বাঁ হাতটা সোজা মাটির অনুভূমিক রেখে মন্তা যাচ্ছে। সবুজ বালতির জল টলটল করে নড়ছে। আকাশের সাদা মেঘের ছায়া দুলছে বালতির হাঁ মুখে। মন্তা টাল সামলে হাঁটছে। যেন মাঝ সমুদ্র থেকে আসা ডিঙি দুলতে দুলতে পাড়ের দিকে আসছে।
       মন্তার কোমরের থেকে একটা গামছা হাঁটু অবধি বেড় দেওয়া। খালি গা। পাঁজরেররা পলিমাটির স্তরের মত থাকে থাকে তার সারা বুক জমে। মন্তা কথা বলে না। চীৎকার করে গাল পাড়ে মাঝে মাঝে একে তাকে। কথা জড়িয়ে যায়। দাঁত পড়ে গেছে কয়েকটা সামনের দিকে। মন্তা কখন খায়, শোয় কেউ জানে না।
       সবাই ভেবেছিল যেমনভাবে কুকুরবেড়াল বিনা আড়ম্বরে অলক্ষ্যে মারা যায় মন্তার শেষ জীবনটাও বুঝি তেমন হবে। তার থাকাটা, না থাকারই মত নিরুপদ্রব হবে। কিন্তু হল না। মন্তাকে নিয়েও যে গল্প হতে পারে আমিও কি ভেবেছি কোনোদিন।
       একদিন সকালে মন্দিরের সামনে খুব গোলমাল। মন্তা কালীর পাশে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে। তার পায়ের তলায় একটা মহাদেবের ছবি। মন্তার গলায় জবাফুলের মালা, যে মালা সে নিজেই গাঁথে রোজ কালীর জন্য। তাকে আনতে গেলেই সে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। প্রধান পুরোহিত মাথায় হাত দিয়ে মন্দিরের এক ধারে বসে। কেউ কথা বলতে গেলে হাতের ইশারায় সরে যেতে বলছে। কেউ কেউ খেয়াল করেছে পুরোহিতের চোখটা ভিজে, টকটকে লাল।
       মন্তা নিরস্ত হল দুপুরে। ঘুমিয়ে পড়ার পর তাকে তার ঘরে নিয়ে আসা হল। গলার মালাটা খুলতে বারণ করল পুরোহিত। মন্তা আর জাগল না। একটা আচ্ছন্নতায় কাটিয়ে দিন চারেক, মারা গেল। না ডাক্তার ডাকা হল, না কবিরাজ। শুধু চরণামৃত দেওয়া হল দিনে সাতবার। কম পাপ করেছে। শাপ তো লাগবেই! মায়ের পাশে..তাও শিবের বুকে? ছি ছি ছি, এই ওর প্রায়শ্চিত্ত । মন্তা যখন শ্মশানে চলেছে তখনও গলায় জবার মালাটা পরানো। ফুলগুলো শুকিয়ে লাল ছোটো ছোটো আরশোলার মত দেখাচ্ছে। সুতোটা কালো হয়ে গেছে। মন্তার সৎকার করার জন্য চাঁদা তোলা হল। মন্দির কর্তৃপক্ষ পাঁচশো টাকা দিল।
       মন্দিরের বাইরে টাঙানো দড়ি, কল, কলসী, ড্রাম, বিগ্রহ সব একইরকম। নতুন একজন মহিলা এসেছে কাজে। বিধবা। মন্তার ঘরে নারায়ণ পুজো হয়েছে দোষ কাটাতে । কিন্তু সে বিধবা দুদিনের বেশি সে ঘরে টিকল না। মন্তা নাকি রাতে জবার মালা পরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে, গালাগাল করছে। লোকে বলল, মন্তা পুজো চায়। বিধান হল বিগ্রহের এক পাশে মন্তার একটা ছবি থাকবে। মায়ের পুজোর পর ওর পুজোও হবে। মন্তা নিশ্চয় সিদ্ধপুরুষ ছিল।
তাই ঠিক হল। মন্দিরে নতুন পুরোহিত এলো। পুরোনোজন ইস্তফা দিল। শোনা যাচ্ছে মন্তার নামে পাশে একটা মন্দিরও হতে পারে। এবারের ভোটে বিল্টুবাবু জিতলেই এ পাড়ায় প্রথম মন্তার মন্দিরের কাজেই হাত দেবেন, কথা দিয়েছেন। মায়ের ছেলে মন্তা।