ঘুম থেকে উঠেই হীরার ঘাড়ের কাছটা ব্যথা ব্যথা করছে। শোয়াটা ঠিক হয়নি। বেকায়দাতে শুয়েছে বোধহয়। সারা গা-হাত-পায়েও খুব ব্যথা। কপালে হাত দিয়ে দেখল, না, জ্বর নেই, বাঁচোয়া। সামনের একচিলতে বারান্দাটায় এসে বসল। বসেই উঁকি দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল ঘরে, সাতটা বাজে। মা এতক্ষণে কাজে বেরিয়ে গেছে নিশ্চই।
হীরা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। বাবার মুখটা মনে এল। কার সাথে কোন ছোটবেলায় চলে গেছে হীরার মনে নেই। মায়ের মুখে শুনেছে বহুবার সে গল্প। হীরাদের এই বস্তিতে এই ঘটনা এমন কিছু আহামরি নয়। কেউ মাথাও ঘামায় না এসব নিয়ে। তবু হীরা কোথাও একটু আলাদা রকম। মাধ্যমিক অবধি পড়েছে। কোনো ছেলে তার শরীরে হাত দেওয়ার সাহস করেনি কোনোদিন।
প্রথম ভাল লাগা তার জীবনে ওই কাত্তিকই। ইলেকট্রিকের কাজ করত। তার থেকে চার বছরের বড় ছিল। তখন হীরা মাধ্যমিক পাশ করেছে তিন বছর হল। আর পড়াশোনা এগোলো না নানান ঝুটঝামেলায়। সেলাই শেখা শুরু করল রমা বৌদির কাছে। ওদের বাড়িতেই কাত্তিকের সাথে আলাপ। ওদের বাড়ির ইলেকট্রিকের যাবতীয় কাজ ও-ই দেখত। এইট পাশ। রোগাসোগা। কালো। হীরার ভাল লেগেছিল চোখদুটো, কি নিষ্পাপ! রমাবৌদির বর মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান। কাত্তিককে স্বপ্ন দেখিয়েছিল মিউনিসিপ্যালটিতে চাকরি করে দেবে বলাইদা।
আচমকা রমাবৌদির স্ট্রোক হল। কোমরের নীচ থেকে সম্পূর্ণ অসাড়। কত চিকিৎসা হল। সব বেকার। হীরাকে রাখা হল চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক হিসাবে।
আর সব ক্ষেত্রে যা হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। বলাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রঙ পাল্টাল। রমার থেকে হীরাকে প্রয়োজন তার বেশি। হীরা তার মা'কে বলল। সুরাহা হল না। ‘জলে থেকে কুমীর আর ডাঙায় থেকে বাঘের সাথে লড়াই? ধর্ষণ করে পুঁতে ফেললেও টের পাবি না রে মুখপুড়ী। বুদ্ধি রেখে চল। মেয়েমানুষের গতর পেয়েছ, চিল শকুন না খ্যাদাতে শিখলে যে শেয়ালে কুকুরে ছিঁড়ে খাবে। আর এতো বাঘ!’
হীরা কাত্তিককে কেন জানি কিছুতেই বলতে পারল না। তবে কাত্তিক জেনে গেল। এসব খবর কি আর চাপা থাকে! একদিন রাত্তিরে তার বাড়ি এল। আকণ্ঠ মদ খেয়ে। তার সাথে জোর করতে চাইল। হীরা দিল না। অন্তত একটা চোখে সে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিল হয় তো। ভুল করেছিল। সেদিনের রাতের মাশুল দিতে হল পরের দিন সকালে। ভোরের ট্রেনে কাত্তিক কাটা পড়ল। লোকে বলল মাল খেয়ে লাইন পার হচ্ছিল। হীরা চুপ করে রইল।
********** ********* ********** **********
হীরা খগেনকে বলল দোকান থেকে একগ্লাস চা এনে দিতে তাকে। খগেন এই বস্তিতেই থাকে। খগেনের বাপ মুম্বাইতে কাজ করত। এইডস বাধিয়ে নিয়ে এলো। বাপ মা দু'জনেই ওই রোগে মরল। এখন এই বস্তির লোকেরাই ওর দেখাশোনা করে। এর-ওর ফাইফরমাশ খেটে দেয়। বয়স এই বারো-তেরো হবে।
খগেন এক গ্লাস গরম চা, আর দুটো লেড়ো বিস্কুট আনল। জানে একটা বিস্কুট ও নিজে পাবে। হীরা দুটোই ওকে দিয়ে দিল, আর দুটো টাকা। মায়া লাগে ছেলেটাকে দেখলে তার। বড্ড মায়া তার। রোগের মত মায়া। 'এই মায়াই তোকে সোনাগাছির মাগী করে ছাড়বে দেখিস একদিন', ওর মা বলে। কেন বলে বোঝে না। তবে ফুল্লরা পিসী বলে, মা নাকি বাবার সাথে এক কাপড়ে গড়িয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মায়েদের বাপের বাড়ির অবস্থা নাকি ততটাও খারাপ ছিল না, যে অবিনাশের মত মিস্ত্রীর সাথে বিয়ে হত। তার দাদুর নাকি রঙের ঠিকাদারি ছিল, মাঝারি ধরণের। মা অবশ্য মামাবাড়ির কথা মুখেও আনে না। তা এই ফুল্লরা পিসীই নাকি বলেছিল, মা'কে বাবা একবার বেচে দেওয়ার জন্যে মুম্বাই নিয়ে যাচ্ছিল। ‘তোর মা বুদ্ধিমতী বলে বুঝতে পেরে মাঝস্টেশান থেকে নেমে পালিয়ে আসে তোকে নিয়ে’।
হীরার ঘাড়ের ব্যথাটা বাড়ছে মনে হচ্ছে। কাল পশুর মত করছিল বলাই। সারা শরীরে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হামলিয়েছে। রমাবৌদি সব জানে। মেয়েমানুষের চোখের কাছে মেয়েমানুষের মন পরিষ্কার দীঘির জলের মত। চাপা থাকে না। এই রমাবৌদিই তাকে পূজোর সময় গত বছর বলাইয়ের সাথে থাকতে বাধ্য করেছিল। বলাইয়ের জ্বরের অজুহাত দেখিয়ে। রমাবৌদির বোন রমাবৌদিকে নিয়ে দু'দিন তার বাড়ী কাঁকুড়গাছিতে রেখেছিল। রমা বৌদি ফিরে এসে একটা সোনার হারও দিয়েছিল। হীরার যা কষ্ট হচ্ছিল রমাবৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে। কত কষ্টে যেন সব মেনে নিচ্ছিল। কিন্তু হীরা নিজেও তো নিরুপায়। তারও তো কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে। শাওয়ারের জলে স্নান করা, সপ্তাহে চারদিন অন্তত মুরগীর মাংস খাওয়া, ভাল সেন্ট, ভাল শাড়ি পাওয়া মাঝে মাঝে। আর শরীর তো আছেই। গরম রুটির মত দু'দিক সেঁকা খেতেও ভাল লাগে এখন। ভাল লাগে? না নেশার মত হয়ে গেছে, না অভ্যেস সে বোঝে না। তবে বলাই যেদিন মাল খেয়ে ওর ওপর চড়াও হয়, সেদিন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা ওর সারা মন জুড়ে থাকে। ও যেন - ওর শরীরটার ওপর, কাত্তিকের ওপর, নিজের মায়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে বলে মনে হয়। অদ্ভুত তৃপ্তি লাগে। সেদিন যা চায় বলাই তাই দেয়। এই তো গত সপ্তাহে পাঁচ হাজার টাকা এক্সট্রা নিয়ে এসেছে, খগেনের স্কুলের বই কিনবে, স্কুল ড্রেস বানাবে আর নিজের জন্য একটা ভাল নাইটি কিনবে।
********* ********** ************* ***********
হীরা উঠে দাঁড়াল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে চলল। রমাবৌদিকে স্নান করাতে হবে। সে তাড়াতাড়ি করে উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঘরে ঢুকতেই শুনল খুব হাসির আওয়াজ। রমাবৌদিকে জিজ্ঞাসা করল, 'কে গো বৌদি?' রমাবৌদির মুখ কালো হয়ে এলো। বলল, 'মিউনিসিপ্যালটিতে কাজ করে, বিজুলী। ডিভোর্সি। এক বছরও স্বামীর সাথে ঘর করেছে কিনা সন্দেহ মাগী!'
হীরা বৌদির মুখে এরকম ভাষা শুনতে অভ্যস্ত নয়। বৌদিকে এতটা অস্থির, হতাশও দেখেনি সে আগে। ওদিক থেকে হাঁক এলো, 'হীরা আমাদের একটু চা দাও তো, আর কিছু একটা জলখাবার বানাও।'
বলাইয়ের গলার আওয়াজটা অপরিচিত লাগল হীরার। চা নিয়ে যখন ঢুকল, তার সারা মনে বিষযন্ত্রণা। বিজুলী তাকে মাপছে বুঝল। বয়েস পঁয়ত্রিশের নীচে হবে। বলাইয়ের কত হবে, ঊনচল্লিশ। রমাবৌদি আর বলাই তো সমবয়সী। হীরা বলাইকে 'দাদা' বলতে পারে না। বাইরে সবার সামনে অবশ্য তাই বলে।
এই ঘটনার পর মাস চারেক হল, এত তাড়াতাড়ি এতটা বাড়াবড়ি হবে, ভাবতেও পারেনি হীরা। রমাবৌদির পিঠে-পা'য়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা। মারের দাগ। প্রায়ই শনি-রবিবার দীঘা যাচ্ছে বলাই, বিজুলীর সাথে। রাক্ষুসী মাগী। চোখ দেখেই বুঝেছিল হীরা। তা বলে এতটা, এত তাড়াতাড়ি?!
হীরার রাত্তিরে ঘুম ছুটল। খালি খালি দুঃস্বপ্ন আসতে লাগল। কে যেন তাকে জোর করে রেললাইনের সাথে বেঁধে রেখেছে। দূর থেকে আসছে মুম্বাই মেল। রমাবৌদি আর খগেন ওর বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওদিকে বলাই বিজুলী আর ওর মা মড়ার খাট সাজাচ্ছে তার জন্য। কাত্তিক মাল খেয়ে দু'টুকরো হয়ে লাইনে শুয়ে আছে, আর তাকে ডাকছে, আয় হীরা, আয় আয় আয়...
বলাইয়ের মৃত্যুসংবাদটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল। খাবারে বিষক্রিয়া। চারদিনের মধ্যেই হীরা ধরা পড়ল। রমাবৌদি অবশ্য অনেকবার বলেছিল পালাতে। সে পালায়নি। শকুন, শিয়াল, কুকুর, বাঘ তো সর্বত্র। তাকে যখন পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছিল সে শুধু একবার খগেনকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। বারবার বলত লাগল, 'তুই কিন্তু তোর রমা কাকিমার কাছ থেকে একপা-ও কোনোদিন কোথাও যাবি না। মানুষের মত মানুষ হবি। না হলে আমার সব ব্যর্থ হবে, আমি হেরে যাব রে...'
খগেনও খুব কাঁদল। কিছুই কি সে বোঝেনি? বুঝেছে। এই বস্তিতে বাচ্চা থাকবে কদ্দিন আর! সে দুটো দামী বিস্কুট প্যাকেট নিজের জমানো পয়সা দিয়ে কিনে এনেছিল। সেটা হীরার হাতে দিয়ে বলল, 'এটা নাও। আর এই লকেটটা রাখো, আমার মায়ের, আমি তোমায় রোজ জেলে দেখতে আসব। আর দেখো আমি খুব বড় চাকরি করে তোমাকে...'
কথাটা শেষ করতে পারল না। গলা বুজে এল। পুলিশের গাড়ি চোখের সামনে মিলিয়ে গেল বস্তি ছাড়িয়ে।
হীরার মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, 'এই মায়াই তোর কাল হল হীরা...', খগেনকে বলল, 'আয় তোকে তৈরি করে ও বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে কাজে যাই...'
(ছবিঃ সুমন)