Skip to main content

 

গোঁসাই, আজ গুরুপূর্ণিমা। আমি একা আছি আজ। অনেক দূরে। তোমার থেকে অনেক দূরে। চিন্তার জালে আটকে। বিষাদে অবসাদে ভেঙে চুরচুর। আমার কিছু হবে না গোঁসাই। আজ তোমাকে এতদূর থেকে বসে এই যে লিখছি, শুধু তোমার সঙ্গে কথা বলব বলে। ফোন করলেও হত, কিন্তু আজ যে ভীষণ ভিড় তোমার আশ্রমে!

গোঁসাই, আমি আমার সংশয়ে, বিষাদে, শূন্যতায় একা। বিচ্ছিন্ন। আমি তোমার থেকে দূরে গেলেই আমার সব সুখ, সব আনন্দ ম্লান হতে থাকে গোঁসাই। হাজার একটা চিন্তা। হাজার একটা জট মাথায় পাকে। সব রহস্যের চাবিকাঠি যেন আমার জানা। অথচ আমি নিজেই নিজের কাছে রহস্য গোঁসাই।

ফোন বাজল...... তুমি!

"কী গো, কাজ কদ্দূর?"

আমায় মনে পড়বে জানতাম। কিন্তু ফোন করবেন, আশা করিনি।

"ওদিকে ঠাণ্ডা তো খুব, পাহাড়ে গেছ না?"

আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশ ঠাণ্ডা।.... জানেন আমি লিখছিলাম.....

"পড়ো"।

পড়লাম।

"এ তো বিরহ গো। ভালো ভালো। মন যখন আঁধার করে আসে। জানবে ঝেঁপে বৃষ্টি হবে। তুমি ওই গানটা শুনেছ? 'গৌরাঙ্গ বলিতে হবে, পুলক শরীর। হরি হরি বলিতে নয়নে বহে নীর।।' গানটা শোনো। নরোত্তম ঠাকুরের পদ। মেঘ যখন জমেছে বৃষ্টি তখন হবেই। তোমরা বড্ড অস্থির হও। চঞ্চল হও। ভয় পেয়ে যাও। ভয় পেও না।"

সব বদলে গেল। এ তো ভবিষ্যতের ফাঁকা আশ্বাস না। এ তো ডাক। এই তো ডাক। আমার সামনে পাইনের সারি বেয়ে নামছে কুয়াশা। রোদ নেই। সব মিলিয়ে কী এক সুরে বেঁধে গেল। গোঁসাই ফোন রেখে দিয়েছে। কিন্তু গোঁসাইয়ের শ্বাসপ্রশ্বাস যেন আমার এই ছোটো হোমস্টে-র মধ্যে গুনগুন করছে। 'গৌরাঙ্গ বলিতে হবে, পুলক শরীর। হরি হরি বলিতে নয়নের বহে নীর।।' নেট স্লো। গানটা শোনা যাবে না। কিন্তু গানটা তো জানা। গান হারালে সব অন্ধকার। 'গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে। গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে।'

গৌরাঙ্গ তো ডাক। ভাঙার ডাক। ভাসার ডাক। গোঁসাই গোবিন্দকে সুরে পান। সুর হারালে সব হারিয়ে যায়। নামের মধ্যে সুর আছে। কিন্তু গৌরাঙ্গ না জাগালে সে সুর জাগে না। গৌরাঙ্গের পাঠশালায় গিয়ে বসতে হয়।

এই মধু! এই তো! প্রতিপদে এ পদের আস্বাদান। 'লাখ লাখ যুগ হিয় হিয় রাখনু / তবু হিয়া জুড়ানো না গেল।'

সামনের পাইনের সারির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। কোথাও কিছু খোঁজার নেই আমার। কোনো জটিল ধাঁধা সমাধানের নেই। শুধু কান পেতে শোনার আছে বাইরে ভিতরে। কী যেন বাজছে!

একবার মনে হল, গোঁসাইকে ফোন করে বলি, থ্যাংক ইউ।

ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনের মধ্যে গোঁসাইয়ের আনন্দ উদ্ভাসিত মুখটা আলোকিত হয়ে উঠল। সে দূরে কই? এই তো সে। কাছেই। এখানেই। এখনই।

আমি চুপ করে বসে। আমার সব বিষাদ, সব সমস্যা, সব জটিলতা পায়ে পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে, ও কে? বলছে, সঙ্গে এসো। আমার স্মৃতিতে জন্মালো পান্ধারপুরের পাণ্ডুরাঙ্গা'র ছবি। মাসখানেক ধরে আবালবৃদ্ধবনিতা হাঁটতে হাঁটতে, গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে আসে মহারাষ্ট্রের গ্রামগঞ্জ, শহর, শহরতলীর রাস্তা বেয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা একে অন্যকে সম্বোধন করে, 'মাউলি' বলে। সবাই মা। সবাই পাণ্ডুরাঙ্গা। ওই যে সন্তান হারানো মা, লক্ষ মানুষের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছে, ও পাণ্ডুরাঙ্গা। ওই যে সাদা থানটা শুকাতে দিয়েছে রোদে, পতপত করে উড়ছে আষাঢ়ের সজল হাওয়ায়, ওই সাদা থানও পাণ্ডুরাঙ্গা। জাতপাতের বৈষম্য নেই। আনন্দ আর আনন্দ। গলায় তুকারামের পদ। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবও এসেছিলেন এই পান্ধারপুর মন্দিরে। চৈতন্যচরিতামৃতে লেখা হচ্ছে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন,

 

“তথা হইতে পাণ্ডুপুর আইল গৌরচন্দ্র।

বিঠ্‌ঠল ঠাকুর দেখি পাইলা আনন্দ।।

প্রেমাবেশে কইলা বহু নর্তন কীর্তন।

প্রভুর প্রেম দেখি সবার চমৎকার মন।।”

 

তুকারামের পদ, মহাপ্রভুর আকুতি, বিদ্যাপতির পদ, রবীন্দ্রনাথের সুর…. সব কোথায় যেন মিলে আছে। প্রাণের কোটরে রাখা মহামূল্যবান রত্ন পেটিকা। খোলা হয় না অনভ্যাসে। বাইরের ধুলো-আবর্জনা মেখে আর ধুয়ে, আবার মেখে আর ধুয়ে দিন যাচ্ছে….. উদ্ধার করো প্রভু…. এ ঘোর আবিলতা থেকে বাঁচাও….. আমিই আমাকে শেষ করে দিচ্ছি…. আমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করো….. নাহং…. নাহং…. তুঁহু… তুঁহু….