মুড়ি ভীষণ নিরহংকারী। মুড়ি দেখলে, মুড়ি স্পর্শ করলে, মুড়ি চিবোলে মনের অহংকার নাশ হয়। কলির এই ক্লাইমেক্স কালে হরিনামের চাইতেও শুদ্ধচিত্ত হওয়া সম্ভব মুড়ির মাধ্যমে। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ইত্যাদি সবেতেই এক ফল। অহংনাশ। পিত্তিনাশ। একসঙ্গে হবে। হবেই হবে।
মুড়ি শুধু খান, তরকারি দিয়ে খান, জল ঢেলে খান, চানাচুর ইত্যাদি দিয়ে রাজসিকগুণে মেখে খান, মুড়ি না বলবে না। সবেতেই সে রাজী। এমনকি মুড়ি খেয়ে কেউ অসুস্থ হয়েছে বলেও আমি আজ অবধি শুনিনি। বরং উল্টোটা শুনেছি, যে মুড়ি খেয়ে সুস্থ হয়ে গেছে। বাড়িতে বসে খান, বেড়াতে গিয়ে খান, মাঠে বসে খান, স্টেশানে দাঁড়িয়ে খান, ট্রেনে বসে খান - সবেতেই হবে।
মুড়ি মোহমুদগরের মত কাজ করে। আমার এক জেঠু। অনেক উঁচু পদে কাজ করেন। বেজায় দেমাক। ফ্লাইটে করে চেন্নাই থেকে ফিরছেন। ফ্লাইটে উঠেই চোঁয়া ঢেকুর, টকটক মুখ, পেটে যেন সূঁচ ফোটানো যন্ত্রণা। এই সময় কি চাই? একটু শুকনো মুড়ি আর ঠাণ্ডা লিকার চা, চিনি ছাড়া বা স্বল্প। বড় মুখ করে বিমানসেবিকার কাছে চাইলেন, "আপনাদের কাছে মুড়ি হবে?" সে বিমানসেবিকা নাকি এমন তাকিয়েছিলেন জেঠুর দিকে, জেঠুর ভাষায় যেন হরিদ্বারে ক্যাঙারু চেয়েছি! জেঠুর প্রাণ এদিকে যায় যায়। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে নামলেন। নেমেই সেই প্রথম জেঠু অটোতে উঠলেন, নইলে ফ্লাইট থেকে নেমে উনি কক্ষনো অটোতে চড়তেন না, তখন ওলা-উবের ভারতে ভূমিষ্ঠ হয়নি, তাই হলুদ অ্যাম্বাসেডর চড়তেন। কিন্তু আজ অটো। অটোওয়ালাকে বলে একটা দোকানে দাঁড়ালেন। এক ঠোঙা মুড়ি আর কয়েকটা চিনির বাতাসা কিনে কয়েক মুঠো খেলেন, ব্যস! হুস! আর গ্যাস নেই! রাধিকার মধ্যরাতে যমুনাতটে কৃষ্ণকে দেখে যে সুখ, এ তাই। প্রাণনাথ এই তো প্রাণের কূলে। জেঠুর দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা। টপটপ করে মুড়ির ঠোঙায় পড়ছে। মুড়ি মিইয়ে যাচ্ছে। জেঠু ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন আর খাচ্ছেন, খাচ্ছেন আর কাঁদছেন। সেই গ্যাসাসুর নিজের সমস্ত ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে ক্রমে ইংরাজি ভাষায় নিন্দিত নিম্নদ্বার দিয়ে বেরিয়ে কলকাতার বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। বলেছিলাম না মুড়ি অহংনাশী। সে অহং যারই হোক, মুড়ি নাশ করবেই। এরপর থেকে জেঠু যেখানে যেতেন সঙ্গে মুড়ি থাকত। আর জেঠু সব সময় বলতেন যে দেশে মুড়ি নেই, যে মানুষের জিহ্বা মুড়ির গুণাগুণবর্জিত, সে অহংকারী পাষণ্ড। আগেকার দিন হলে জেঠুকে নিয়ে মুড়ি পাঁচালি লেখা হত, ঘরে ঘরে পাঠ হত। কিন্তু এখন লোকের জিহ্বায় নানা রজগুণীয় ত্বরাখাদ্যের স্বাদ, মানে ফাস্টফুড আরকি। তাই পাঁচালি আর লেখা হল না।
সে যাক, আজ কেন এসব লিখছি। কাল আমার এক শুভানুধ্যায়ী আমায় মুড়ি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আহা! সেকি স্বাদ, সেকি মাখা! লোকের বাড়ি খেতে ডাকলে চেয়ে খেতে আমার লজ্জা করে। কিন্তু আজ চাইতে লজ্জা বোধ হল কই? মুড়ি চাইলে লজ্জা হয় না। বরং মনে এক স্বর্গীয় প্রসন্নতা জন্মায়। আমি হলফ করে বলতে পারি মুড়িকেই বিশল্যকরণী আর অমৃত বলা হয়। কারণ ব্যাখ্যা করেই এ প্রসঙ্গের ইতি টানি।
আমি দিল্লী থেকে ফিরছি। স্টেশানে একটা সাদা বালিশের ওয়াড়ের মত ন্যাতানো স্যাণ্ডুইচ খেলাম। দুরন্ত এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বুঝলাম যতক্ষণ সিটে থাকা আমার ভাগ্যে তার চাইতেও বেশি থাকতে হবে শৌচালয়ে। যাই আর আসি। আসি আর যাই। টিটি আমার দেখা পায় না, আমিও টিটি'র না। পাশের সিটের লোক আশ্বস্ত করে বলেন, "উনি আছেন, আবার নেই। মানে নেই, আবার আছেনও।" এমন দার্শনিক উক্তি শুনে উনি আর নাকি এই কোচের দিকে আসেননি। পাছে আরো জটিল কোনো অবস্থায় আমায় দেখতে হয়, মানে এই ছিলেন, এই গেলেন।
যা হোক, সে যাত্রায় কে আমার প্রাণ শরীরের বাঁধনে আটকে রেখেছিল? এক ব্যাগ মুড়ি। থুড়ি, এক প্যাকেট। জলে ভেজাই আর কিছুটা পান করি, কিছুটা চর্বণ। সেইতেই ধীরে ধীরে সে প্রবল গোলোযোগের হাত থেকে রেহাই পাই এবং দুরন্ত এক্সপ্রেস আমার জীবন্ত দেহ নিয়েই হাওড়ায় ঢোকে।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। মুড়ির গুণাগুণ আরো দশজনকে জানান। আর এই লেখা যে পাঠ করবে, এবং পাঠের শেষে এক মুঠো মুড়ি খেয়ে, শীতল জল পান করবে, তার ঘরে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি অচলা হবে। শান্তি শান্তি শান্তি...
সৌরভ ভটচায ভণে মুড়িগুণলীলা।
অজীর্ণ ক্ষুধামান্দ্য যাহে সব্বু পসারিলা।।
[ছবি: Suman Das]