সৌরভ ভট্টাচার্য
24 December 2016
“যত দরিদ্রই হই, সংসারে স্নেহ- ভালোবাসার জন্য আমার আপন লোক আছে, এই ভরসা ছাড়া মানুষ বাঁচে কি করে?”
সারাটা জীবন অভাব-অনটন, স্বামী পরিত্যক্তা এক রমণী তার বিবাহ উপযুক্ত ছেলেকে বাড়ির দাওয়ায় বসে এই প্রশ্ন করছেন। দক্ষিণ ভারতের ছোট্ট একটা গ্রাম। বাড়ির কিছু দূরেই সমুদ্র। সেই সমুদ্র তীরে মায়ে পোয়ে গিয়ে বসে। সময়ের ঠিক থাকে না। সব দুঃখ ক্ষোভ নোনাজলে মিশে যায়। কত কথা হয়। সব কথাই জীবনকে ঘিরে। অনেক পড়েও চাকরি হয়নি ছেলের। তাতে তার ক্ষোভ নেই। গ্রামের মাটি আছে তো, শ্রমও আছে।
“মেয়ে যে আনতে বলছ, সেকি এই তামাক বাগানে রোজ জল দিতে পারবে? সকাল বিকাল মাঠে পরিশ্রম করতে পারবে তোমার আমার মত?”
নাগবেণী হাসল রামের কথা শুনে। বলল, আমি যখন এ বাড়িতে আসি তখনও কি জানতাম রে এই সব আমার কপালে আছে? ও কেউ আগে থাকতে ঠিক করে রাখতে পারে না।
বইয়ের নাম - মাটির টানে। লেখক - শিবরাম কারন্ত। মূল ভাষা - কন্নড়। প্রকাশক - সাহিত্য একাদেমি। অনুবাদক - বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য। মূল্য – ১৮০/- । পাতার সংখ্যা - ৩৭২।
যে বইয়ের মুখবন্ধ লেখেন স্বয়ং সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়, এবং যে বই শেষ করতে ওনার মাত্র দুদিন লাগে, সেই বই সম্বন্ধে কিছু বলতে যাওয়া বাতুলতা। তবে মিষ্টি আম খেয়ে মুখ মুছে ফেলতে নেই বা স্বভাবে নেই বলেই এই পোস্ট।
শিবরাম কারন্ত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলছেন আধুনিক ভারতবর্ষের রবীন্দ্রনাথ। কথাটা হয় তো অত্যুক্তি নয়। এই উপন্যাসটা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে লেখক স্বয়ং লিখছেন, “আমার কাছে সমগ্র ভারতবর্ষ একই ঐতিহ্যের ধারাবাহী। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি মূলত অভিন্ন"।
খুব সত্যি কথা। খুব খুব খুব সত্যি কথা। তাই শিবরাম ভারতের আত্মাকে স্পর্শ করেছেন। যেন মায়ের আঁচলের গন্ধ পুরো উপন্যাসটার পাতায় পাতায়। সুনীতিবাবুর ভাষায়, “...এরা আমাদেরই ঘরের মেয়ে। বাঙালি পরিবারেও পার্বতীর অন্তিমদশার বর্ণনা অপরিচিত নয়।” নয় বলেই পড়তে পড়তে নিজের পরিচিত মুখগুলো ভেসে আসছে, প্রাণের দুঃখ চোখের জলে উপচে পড়ছে নিজের ভাষায়। এ অনুভূতিকে আর কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায়? যায় না। এ একান্তই আমার দেশের ভাষা, নিজের ভাষা, আমার দেশের ঐতিহ্যের বাহক।
আমি যেমন জন্মলগ্নেই একটা শরীর পেয়েছি, বাবা-মা আর পরিবার পেয়েছি, তেমনই একটা দেশ পেয়েছি, একটা ঐতিহ্য পেয়েছি। আমার দেহ, বাবা-মা যেমন অপরিবর্তনীয় তেমনই আমার দেশ, ঐতিহ্য সংস্কৃতিও। তাকে বহন করার, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় সবার মত আমার উপরেও। অঙ্গভঙ্গিতে ভারত সাজাও যেমন লজ্জার তেমন তাকে করুণা করে গ্রহন করার মনোভাবও ধিক্কারের।
শিবরাম এর কোনোটাই নন। তিনি ভারতীয় সাজতে চেষ্টা করেননি, জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বিচার করতে বসেননি। তাঁর হাতে পায়ে মননে ভারতের নিজস্ব আলো আকাশ বাতাস। কোনো দেশকে তার স্ট্যাটেস্টিক্স দিয়ে জানা যায় না। যেমন কোনো এক দার্শনিক বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের জামা কাপড়ের হিসাব, অস্ত্রের হিসাব, আর ঘোড়া রথের হিসাব জানলেই পুরোটা জানা হয় না, সে মানুষটার যন্ত্রণার মনোকষ্টের, ত্যাগের, তার পরিবার পরিজনদের শোকের পরিমাণ জানবে কোন পরিসংখ্যানবিদ? তাই পরবাসী বিদ্বান ভারতীয়েরা ভারতে এসে যখন ইংরাজীতে কি বিকৃত মাতৃভাষা উচ্চারণে আমাদের কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না বোঝাতে যান, হাসিই পায়। রবি ঠাকুর যদি প্যারিসে একটা বাড়ি হাঁকিয়ে তাঁর সৃষ্টি জীবনে মেতে থাকতেন কার কি বলার ছিল? তবে তাঁর লাঙল ধরা ছবিটা আর 'ফিরে চল মাটির টানে' শুধুই একটা মুহুর্ত হত, তত্ত্ব হত, জীবন হত না। আমাদের শোকে বিষাদে সুখে আনন্দে এমন করে ঘরের মেঝেতে আসন পেতে বলতে পারতুম না - এসো। একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেই নিস্তার পেতুম সেই মহান বিদেশবাসী স্বদেশী আত্মীয়ের জন্য।
আসলে সমস্যাটা তো সেই একই, যারা বোঝে না তাদের নিয়ে সমস্যা কম, যারা বোঝে তাদের নিয়ে তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা মাঝারিদের নিয়ে, তারা যে বোঝেনি এটা বোঝাবো কি করে?