Skip to main content

 

 

 

ভোর ছ'টা এগারোতে ট্রেন। রাণাঘাট লোকাল, হালিশহরে। উঠলাম। ফাঁকাই বলা চলে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। সিটে বসলাম না। আরে বাবা রাতদিন বাড়ির ভিতর বসেই তো আছি, আর কতদিন বসে থাকা যায়!

 

 

দরজার কাছে দাঁড়ালাম। কাঁচরাপাড়া কল্যাণী ছেড়ে গেল। সূর্যোদয় হচ্ছে। ধানক্ষেতে কুয়াশার চাদর। জল জমে আছে। মাথা তুলে আছে ছোটো ছোটো ধানের চারা। সেই জলে সূর্যের ছায়া। স্টেশানে স্টেশানে দিন শুরুর তাড়া। খবরের কাগজের স্তূপ, আনাজের স্তূপ, ব্যস্ত বাজার, চায়ের দোকানের ভিড়, সিনেমার পোস্টার, সাইকেলে পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়ের দল, দুধের ক্যান নিয়ে ধাওয়া দুধওয়ালা এই সব দেখতে দেখতে শহর, গ্রাম, খালবিল, মাঠঘাট পেরিয়ে ঢুকলাম রাণাঘাটে। তাল কাটল শুধু ট্রেনের মধ্যে ঘোষণার যন্ত্রটি। বেশ কাজের জিনিস, পরের স্টেশান কি বলে দিচ্ছে আগে থেকেই। কিন্তু যেই না গান থামা, অমনি 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে' বাজতে শুরু করছে পিয়ানোতে। এখন অমন শীতের সকাল তার মধ্যে কে এই গানটা মেনে নিতে পারে? আরে মশায় আমি তো লালমোহন গাঙ্গুলি নই!

 

রাণাঘাটে পৌঁছে বেশ কিছুটা হেঁটে একটা ফাঁকা চায়ের দোকান খুঁজলাম। পেলাম। অল্প কয়েকজন দাঁড়িয়ে। চায়ের অর্ডার দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, কি করা যায়। সামনের দেওয়ালে কিসের একটা পোস্টার। গানের অনুষ্ঠানের মনে হল। এগোলাম। সামনেই একজন টোটোওয়ালা দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন কারোর সঙ্গে, পাশে টোটোটা রাখা। আমায় দেখেই বললেন, যাবেন বুঝি কোথাও? আমি বললাম, যাবই তো, কিন্তু এখন না, এখন আমি চা-বিস্কুট খাব, মনে হলে একটা কেকও খেতে পারি।

টোটোওয়ালা হেসে বললেন, তবে আমি গিয়ে একটু চা খেয়ে আসি?

আহা, যাবেন বইকি বিলক্ষণ যাবেন, যান যান চা খেয়ে আসুন।

টোটো না, অটোতে যাওয়া হবে ঠিক হল। বেশ, তাই হোক। সব বন্ধুরা দুটো অটোতে উঠলাম। অটো সদ্য ঘুম থেকে উঠে, আড়ামোড়া ভাঙা রাণাঘাট শহরকে টাটা করতে করতে গ্রামের রাস্তায় গিয়ে পড়ল। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। টিনের দেওয়ালের বাড়ি, টিনের ছাওনি, মুরগী, ছাগল, গরু চরছে। মাস্কহীন মানুষ চারদিকে। আমার নাকের ডগায় এন৯৫ কি করতে? আর তো ভাল্লাগে না। কিন্তু এখন খোলা ঠিক হবে না, যদি কেউ হেঁচে দেয়, বলা তো যায় না! ও অটো দাদা, আপনার ভ্যাক্সিন হয়েছে?

ভ্যাক্সিন হয়েছে, আলফা, ডেল্টা, ওমিক্রন সবই হয়েছে।

আর কিছু জিগাবার আছে মন? নেই। চুপটি করে বসে থাক। গন্তব্য, মাটিকুমড়ো। সেখানে আছে নার্সারি, সেই নার্সারিতে থাকার বন্দোবস্ত করেছেন আমার এক ভাই।

 

 

 

নার্সারির সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। নামতেই গাছে ফুলে ঢাকা দরজা। পার হতেই ডানহাতে বাড়ি, সোজা সরু রাস্তা, দু'দিকে সে যে কত কত ফুলের গাছ আর ফুল বাবা রে বাবা! সে সরু রাস্তায় মাথার উপর ঢেউ খেলানো ছাওনি। সেই ছাওনির নীচ থেকে ঝুলে আরেক ধরণের ফুল। বাঁদিকে যাও আরো কত কত গাছ। শুধু কি ফুল? কত কত ধরণের গাছ! আরে সামনে ওটা কি?

 

 

ট্রি হাউস! বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাও। ভিতরে চার-পাঁচজনের শোয়ার বিছানা। সামনে কাঁচের দেওয়াল। তার ওপারে ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। যেন ওই দেখা যায় তেপান্তরের মাঠ। নামলাম গাছবাড়ি থেকে। নামতেই বেশ সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা আর টেবিল। বসে বসে গল্প করো, চা-কফি খাও, কি বই পড়ো, গান শোনো আর দৃষ্টিকে দাও অনন্ত নীল-সবুজে ছুটি। সে কোথাও বাধা পাবে না। শ্বাসে কোনো কৃত্রিম গন্ধ নেই। কানে পাখির কলতান।

 

 

বাকি ঘর কেমন? দোতলা। নীচে একটা বড় হলঘর, সেখানে ছ-সাতজন শুতে পারা যায়, পাশে একটা ঘর, সেখানেও তিনজন মত শুয়ে যাওয়া যায়। হলঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচ পশ্চিমী টয়লেট।

 

উপরে আরো ঘর। বাথটব। একটা রাস্তার দিকে সুন্দর একজনের খাট পাতা। সামনে বেশ কয়েকটা চেয়ার আর গাছপালার টব। কাঁচের দেওয়াল। পর্দা টানলেই আলো আর গ্রামের রাস্তা।

 

নীচে নামলাম। একটা খড়ের ছাওনি দেওয়া গোল জায়গা খোলামেলা। বসার জায়গা গোল করে। বেশ আড্ডা দেওয়ার জায়গা। এই নার্সারির মালিক নাটকের মানুষ। অনেক নাটকের ব্যক্তিত্ব এসেছেন দেখলাম। ছবি আছে। ঢুকতেই দেবশঙ্কর হালদার মশায়ের ছবি দেখলাম।

 

 

 

 

এবার ব্রেকফাস্ট। খাওয়ার জায়গা বেশ। পার্মানেন্ট। অনেক টেবিল চেয়ার। সঙ্গে রান্নাঘর। উল্টোদিকে আরেকটা নির্মীয়মান গাছবাড়ি। তো লুচি, ছোলার ডাল খেয়েটেয়ে এবার বেড়াতে যাবার পালা। নিয়ে যাবে সেই ভাই। কোথায়? না পারমাদনের জঙ্গলে।

 

 

পারমাদন

 

 

 

 

 

 

 

অটো এলো। শুরু হল যাত্রা। অটোতে সে কি ঢিংচ্যাক গান রে বাবা! তায় ডানবামে হেলাহেলি রাস্তা। বললাম, ভাই গান থামা। আর যে কোন্দল সয় না। এই সব চীৎকার হট্টগোলে রাস্তা হারিয়েই তো মন চলো নিজ নিকেতন খুঁজতে আসা বাবা। গান থামলো। কিন্তু ধুলো থামায় কে? গান থামাতেই সে অটোওয়ালা এমন অটো হাঁকালো যেন আমি যুদ্ধজয়ের খবর দিতে যাচ্ছি বিদ্যুৎগামী ঘোড়ায় চড়ে ধুলো উড়িয়ে সম্রাটকে। মাথার চুলগুলো ক্রমে টেরাকোটার কাজের মত অনড়, নানা ভঙ্গিমায় সাজতে শুরু করল। হঠাৎ দেখি অটোওয়ালা প্রধান রাস্তা ছেড়ে এক্কেরে ভাঙাচোরা রাস্তায় বাঁক নিল। বললাম, একি, যাও কই? এদিকে পারমাদন নাকি?

 

সঙ্গীতরসবঞ্চিত ক্ষুব্ধাত্মা বিরসবদনে বলল, না না, এদিকে ভাঙা বাড়ি, আমি কোনোদিন দেখিনি, তবে শুনেছি অনেকে যায়, চলুন।

 

আর চলুন! কোমরের হাড়গুলো নিজেদের চরম স্থৈর্য'র পরিচয় দিল বলেই না এসে পৌঁছালাম পুরোনো বাড়িতে। উফ্, কি দৃশ্য! কোথায় পুরোনো বাড়ি! এ যে নদী। কি অদ্ভুত তার দেহের গঠন, তার রঙ, তার ওপাশে ওই জঙ্গল কিসের? কি নদী এ?

 

কুলমাখা বানাতে বানাতে দোকানি মহিলা বললেন, ওই তো পারমাদন। নদীর নাম ইছামতী।

 

যায় কি করে?

 

কেন ওই যে নৌকা বাঁধা। দশ টাকা দিয়ে চড়ে পড়লেই হয়। তারপর হরিণ দেখো গিয়ে। কুলমাখা খাবেন?

 

খাবো তো। কিন্তু আমাদের দলের সব কচিকাঁচারা কই?

 

ওই যে, নদীর পাড় ঘেঁষে বানানো পার্কে নেমেছে দস্যির দল। কেউ স্লিপে। কেউ ঢেঁকিতে। কেউ দোলনায়। শেষে বয়সের আর গাছপাথর রইল না গো! যে যে পারে স্লিপে চড়ে, দোলনায় দোলে। নদীতে দুটো হাঁসমুখ নৌকা। ওতে প্যাডেল করলে চলে। আমাদের অটোওয়ালারা ওতে চড়ে বসল। ঘাট ছেড়ে ইছামতীর বুকে তারা ভাসছে। এদিকে ফাঁকা পার্কে কিছু ছাগল নিশ্চিন্ত মনে পড়ে থাকা পাতা খেয়ে, সংসারের সুখদুখের গল্প করে বেড়াচ্ছিল। তারা এত হইচইতে ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছাগলোচিত ভাষায় প্রতিবাদ জানালো। আর কি বলব মশায়েরা, দু'জন মানুষ নিরিবিলিতে বসে প্রেম করবে বলে এসেছিল। তা নাকের ডগায় অমন হইহই করে বাচ্চাকাচ্চারা দুলতে থাকলে কারোর প্রেম আসে? বেচারারা অসহায় মুখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকল। যায় কোথায়? আমি পার্ক থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে বসে বসে ঝলমলে নদীর শান্ত স্রোত, বাঁকা সরু মায়াময় তার গতি, তার পাড় ঘেঁষে নানা সবুজের মধ্যে চোখ ডুবিয়ে বিভূতিভূষণ মহাশয়কে বলছি, আসুন, সমস্ত মন বিছিয়ে দিচ্ছি, কথা বলুন। আমি চুপ করি।

 

 

নৌকা পার হলাম। নামতেই বনবিভাগের লোক টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিল। মাথাপিছু ১২০ টাকা, যাও বনে। ঘুরে বেড়াও জালের ধার দিয়ে ধার দিয়ে। ঘুরলাম। আমার বাঁ-পাশে বইছে ইছামতী, তার ওপাশে গ্রাম, মাঠ। আমার ডানপাশে কি গভীর জঙ্গল! সঙ্গে শীতের রোদ। মন ডুবছে। মাথার মধ্যে ফিসফিস করছেন বিভূতিভূষণ। সমস্ত আগাছা, ঝোপঝাড় তাঁর লেখনীর স্মৃতি চুঁইয়ে নেমে নেমে আমায় অবশ করছে। হাঁটছি আর ভাবছি, মানুষের সুখী হতে কত টাকা লাগে? যদি বিভূতিভূষণ প্রাণের গভীরে ভাষার দীপ জ্বেলে থাকেন?

 

হরিণের আড়াইটে-তিনটের সময় খাওয়ায়। কিন্তু সে অবধি অপেক্ষা করা যাবে না। আমাদের সবার বেজায় খিদে পেয়েছে। এদিকেও পার্ক। চলল আরেকপ্রস্ত দাপাদাপি। পেল আরো খিদে। খাঁচায় রাখা নানা ধরণের পাখি দেখেটেখে এবার যাব দত্তপুলিয়ায় খেতে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বেশ খাবার জায়গা দত্তপুলিয়ায়। চারদিকে মাঠ, মাঝে বেশ কিছুটা ঘেরা জায়গা। এদিক ওদিক কিছু চেয়ার টেবিল। আর কয়েকটা ঢাকা জায়গা, সেখানে লম্বা টেবিল পাতা, দু'দিকে চেয়ার। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।

 

গরম গরম বিরিয়ানি এলো মাটির হাঁড়ি করে। দারুণ স্বাদ। দারুণ ব্যবহার। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারদিক। তৃপ্তি করে খাওয়া হল। আমি এক কাপ চা নিয়ে বসলুম। দুপুরের শেষের দিক। শান্ত চারদিক। মানুষের তৈরি শব্দ কিছু নেই। শুধু পাতার শব্দ, কুকুরের ডাকের শব্দ, আর কত কত পাখির শব্দ এদিক ওদিক থেকে। এত শান্তি, এত শান্তি, যেন দীর্ঘদিন পাইনি। কিছু পেয়ে মানুষ শান্তি পায়? না ঝামেলার জিনিসগুলো থেকে দূরে গিয়ে?

 

 

এবার ফেরার পালা। ফিরলাম মাটিকুমড়ো নার্সারিতে। ফ্রেশ হয়ে হাঁটতে বেরোলাম। কত কত চাষের সরঞ্জামের দোকান। কিছু ওষুধের দোকান। বাজার। কাঁচা বাজার, বেশ বড়। তরতাজা তরিতরকারি বালবের আলোয় চকচক করছে। একটা দোকানে চাফি খাওয়া হল, চা আর কফির মিশ্রণ। রাত হচ্ছে। শরীর ক্লান্ত হচ্ছে। এবার ঘুম ডাকছে, আয় আয়। রাতের খাওয়া হল। সন্ধ্যে থেকেই গাছবাড়ি নানা আলোয় সেজে উঠেছে। দারুণ লাগছে দেখতে। নার্সারির মালিক বাইরে গেছেন। ওনার স্ত্রীর আন্তরিক ব্যবহার প্রাণে আত্মীয়তা জাগিয়ে জায়গাটাকে আরো আপন করে তুলল।

 

 

 

 

 

 

 

 

আড়ংঘাটা

 

 

মাটিকুমড়োর ভোর হল পাখির ডাকে, কুয়াশামাখা সূর্যের আলোর ডাকে। রাস্তায় এলাম। হাঁটতে। দেখি বাইকে, ভ্যানে কত কত ফুল যাচ্ছে বাজারে। রাস্তায় দেখেছি প্রচুর ফুলের চাষ হচ্ছে। বাইকের দু'পাশে গোছায় গোছায় গোলাপের সার। মাঠে বাচ্চারা খেলছে। কবাডির মত খেলা কিছু একটা। আমার কিছু বন্ধু ছবি তোলে। তারা দারুণ উৎসাহী হল। ছবি তোলা হল। এবার খেয়েদেয়ে আড়ংঘাটার খিসমার জঙ্গল গন্তব্য।

 

টোটোয় করে এলাম আড়ংঘাটা খিসমার জঙ্গলের সামনে। জঙ্গলের কর্মকর্তার তো মাথায় হাত, এত লোক! তা হবে। আমাদের সব মিলিয়ে আঠারো-উনিশ জন তো ছিলামই। বারণ করলেন। বললেন, বেজায় সাপ। তাছাড়া এ বনে ঢোকা বারণ। আপনারা বরং এক কাজ করুন, ওই দিকে এক দীঘি আছে, বিরাট দীঘি। সেদিকে যান।

 

সেই ভালো, খামোখা সাপের কামড় খেয়ে কিছু লাভ নেই। হাঁটা শুরু করলাম। খানিক আগেই চূর্ণীনদী পেরিয়ে এসেছি টোটোতে। বড় রাস্তা। জোরে জোরে গাড়ি যাচ্ছে। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে এগোচ্ছি। সামনে দেখি বেশ একটা বড় জটলা। কি হয়েছে, সাপ বেরিয়েছে নাকি?

 

এগিয়ে দেখি বড় একটা লরি উল্টে। আজ ভোরেই নাকি উল্টেছে। কেউ হতাহত হয়েছে? না। যাক বাবা। কাছে গিয়ে দেখি লরির নীচের দিকটা উপরে উঠে চিৎ হয়ে শুয়ে লরিটা। যে জিনিস সচরাচর দেখা যায় না, সেটিই যখন আচমকা প্রকাশ্য হয়ে পড়ে তখন মানুষের কৌতুহলের সীমা থাকে না। বাচ্চা বুড়ো সবাই দেখছে। কত আলোচনা হচ্ছে। কোন যন্ত্রের কি কাজ কেউ কেউ বোঝাচ্ছে।

 

 

এগিয়ে গেলাম। বড় রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে কাঁচা রাস্তা ধরলাম। সার দিয়ে বাড়ির সামনে সরষে, টোমাটো শুকাচ্ছে। রাস্তায় টোটোতে আসতে আসতেও দেখলাম কত বাড়ির সামনে টম্যাটো মেলা। সবুজ টম্যাটো। কেন কে জানে?

 

 

কই দীঘি? আরে ওই তো। এদিকে আমরা সব পিকনিকে আসি তো। তাই? তা সে কই? ওই তো আরেকটু এগোলেই। রোদ বাড়ছে। আমাদের গা থেকে শীতবস্ত্র খুলছে। মানে নিজেরাই নিজেদের বস্ত্রহরণ করতে করতে এগোলাম। লোহার গেট। খোলা। ঢুকলাম। সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত দীঘি। সবুজ জলের রঙ। বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। এটা নাকি প্রবীরবাবুর দীঘি, লোকে বলল। মানে পার্সোনাল প্রপার্টিই হবে। দীঘির পাশে মন্দির। কালী মন্দির। লাল পর্দায় ঢাকা। মন্দিরের পিছনে মাটির রাস্তা। একদিকে দীঘি, আরেকদিকে পুকুর। রাস্তা এগিয়ে দু'ভাগ হয়ে গেছে। একদিক দীঘির পাড় ধরে মিশেছে রাস্তায়, আরেকদিক গেছে জঙ্গলের দিকে। খিসমার জঙ্গল।

 

 

দীঘির কোল অবধি নেমে গেছে সিঁড়ি। বাঁধানো সিঁড়ি। অনেকগুলো ধাপ। নামলাম। সিঁড়িতে বসলাম। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ওপাড়ে দূরে কাপড় কাচছেন কিছু মহিলা। আগে কাপড় মাটি ছুঁচ্ছে, পরে শব্দ আসছে। বকের সার উড়ে যাচ্ছে দীঘির উপর দিয়ে। দীঘির গায়ে যেন আলতো করে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। অল্প অল্প ঢেউ উঠছে। কিছু করার নেই। কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। চুপ করে বসে আমরা। কানে আসছে হালকা কাপড় আছড়ানোর শব্দ আর পাখির ডাক। আর আসছে জলের পাড় ছুঁয়ে যাওয়া মৃদু শব্দ। ভিতরটা গলে গলে সময়ের সঙ্গে, এই মূহুর্তটার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অথচ এই একাত্ম হয়ে ওঠা বেশিরভাগ সময়েই কি কঠিন! কত বাধা। কিন্তু কই, এখন তো কোনো বাধা নেই। কি অনায়াসে সমস্ত কিছুর সঙ্গে আমি মিশে যাচ্ছি, সব কিছু কি অনায়াসে আমার মধ্যে আত্তীকরণ হয়ে যাচ্ছে। যেন সব কিছুই আমিই। আমিই সব মিলিয়ে সব অস্তিত্ব হয়ে এই যে জেগে আছি, এই যে হয়ে আছি, এইটুকুই সব। এর কোনো উদ্দেশ্য নেই, এর কোনো গূঢ় অর্থ নেই। সে সবই যেন শুধু মনের নেশা। সব কিছু মানে বানিয়ে বানিয়ে জীবনটাকে অনর্থক জটিল করে তুলে লাভ কি?

 

 

 

এবার বোনের বাড়ি যাওয়া। যাওয়ার আগে ছোট্টো একটা কাজ। আমার পুচকে মামুর স্কুলে ভর্তির দিন আজ। বন্ধন ব্যাঙ্ক স্কুল খুলছে। কি বিশাল তার আয়তন! তৈরি হচ্ছে স্কুলটা। একজন কর্মচারী বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে ঘুরিয়ে দেখালেন। কোন দিকটা বাচ্চাদের জন্য, কোন দিকটা বড়দের জন্য সব বোঝালেন। আমার দেখে সব বড় বিস্ময় জাগল। এমন স্কুল বিদেশী ওয়েব সিরিজে দেখেছি। কি অদ্ভুত সব ডিজাইন। আমি তো সেই লম্বা লম্বা বেঞ্চে বসা, টিফিনে পাউরুটির ভ্যানের অপেক্ষা করা যুগের মানুষ। তারপর বদলেছে তো কত কি, কিন্তু সেই বদলের মধ্যে এমন সরাসরি এসে পড়ে নিজেকে বড্ড কেমন ডাইনোসরের আত্মীয় মনে হতে লাগল। প্রিন্সিপাল কি দারুণ কথা বলেন বাচ্চাদের সঙ্গে। তার ঘরে নানা খেলনা। আমার স্কুলের ঝর্ণা দিদিমণি, ডলি দিদিমণির কথা মনে পড়ল। তারা কেউ আছেন কিনা জানি না। সত্যিই কত কত মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ, কত আপাতভাবে ছোটো কিন্তু পরম মূল্যবান মুহূর্তের জন্য, অথচ তাদের প্রাণ খুলে কৃতজ্ঞতা জানানো হয় না। মনটা খারাপ হল।

 

 
 
 
 
 
 
 

 

পুচকে মামুর অ্যাডমিশান হয়ে গেল। এবার বোনের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পালা। তারপর বাড়ি ফেরার গল্প। সে ঘরের গল্প। সে কথা থাক। বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দাদার যে সুখ, সে সুখ আলাদা, যদি বোনকে সত্যিই সুখী দেখে সে। সে আনন্দের ভাগ হয় না। তাই থাক আপাতত। বেড়াবার গল্প আপাতত এখানেই শেষ... 

 

 

 

(ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা সব বন্ধুদের কাছে।)

 

 

 

 

 

 

 

 

Category