সৌরভ ভট্টাচার্য
14 January 2016
আমরা বলতাম 'মানকাকু'। আসল নাম ক্ষুদিরাম মান। আমার দেখা বিস্ময়কর
মানুষদের মধ্যে একজন। আশ্চর্য মানুষ! আমার সাথে যখন ওনার পরিচয় হয় তখন ওনার দুটো
কিডনির অবস্থাই বেশ খারাপ। বয়েস পাঁচের ঘরের শুরুর দিকে। মাঝে মাঝে ডায়ালেসিসে
যান। উনি জানেন এ রোগের চূড়ান্ত পরিণতি কি। আর সেখানেই উনি অসামান্য। আমি একদিনের
জন্যও ওনার বিষন্ন, আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন মুখ দেখিনি। সদাহাস্যময় প্রসন্নবদনে আমাদের
বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন। ওনার গল্পের বিষয় বয়সের সীমা মানত
না, উনি কি সহজেই আমাদের কাঁধে হাত রেখে আমাদের বয়সী হয়ে উঠতে পারতেন। ওনার কলেজ
জীবনের মজার ঘটনা, চুটকি শুনে হাসতে হাসতে পেটের খিল ব্যাথা হয়ে যেত, চোখ থেকে জল
বেরিয়ে আসত, অথচ কে বলবে এই মানুষটার দিন হাতে গোনা।
ওনার ভাবের, মননের গভীর কেন্দ্রের অধীশ্বর ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আমাদের গল্প হত;
আলোচনা হত ঠাকুর, স্বামীজির, শ্রীশ্রীমায়ের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে। সে সময় ওনার
মুখের পরিমণ্ডল সম্পূর্ণ আলাদা। চোখের কোণে আনন্দাশ্রু। মুখে অপার্থিব তৃপ্তির
হাসি।
উনি রেলে কাজ করতেন। একবার অসুস্থ হয়ে রেলের গার্ডেনরীচ হাসপাতালে ভরতি। আমরা
বন্ধুরা দেখতে গেছি। হাসিমুখে উঠে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন? হাসিমুখে
বললেন, "বেশ ভাল। সেসব কথা থাক। ঠাকুরের কথা বলো। ব্যাগের মধ্যে দেখো একটা
জিনিস আছে।"
ব্যাগ খুলে দেখি, একখানা গীতা। বললেন, "এসো না এই আলোচনা করি। রোগভোগের কথা
বলার জন্য তো এত লোক আছেনই", বলে নার্স ডাক্তারদের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আলোচনায়
মজে গেলেন। কে বলবে এত অসুস্থ মানুষটা।
কাকিমা যদি কখনো কেঁদে ফেলতেন, কাকুর তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ধারাটাও ছিল অন্যরকম।
বলতেন, ফুটবল খেলা দেখোনি গা, একজন খেলোয়াড় যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, কি করে? তাকে অমনি
ভিতরে ডেকে নেয়। তা বলে কি পুরো খেলা বন্ধ হয়ে যায়? যায় না, যায় না।
অথবা বলতেন, দেখো এই যে রেলের কোয়াটার্সটা। আজ আমরা আছি, কাল আবার কেউ আসবে।
এমনিভাবেই তো চলবে। আসা যাওয়া তো থাকবেই গো, ওতে মন খারাপ করলে চলবে কেন?
আমি ভাবতাম, এত মনের জোর মানুষটা পান কোথা থেকে!
আরেকটা দিক না
বললেই নয় - ওনার সত্যপরায়ণতা। বারবার আমাদের বলতেন, "দেখ যাই হোক, মিথ্যা কথা
ভাল না।" আমরা হয়তো কোথাও গেছি একসাথে। ওঠার কথা হয়েছে আটটায়। সেই বাড়ির
লোককে বলা হয়ে গেছে আটটায় বেরোবো। এবার কথা হতে হতে কোনো কারণে হয়তো আটটা বেজে
গেছে। উনি ধীরে ধীরে উঠে বাড়ির দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বলতেন, সত্যরক্ষা
করতে হয়, তবেই সত্য তোমায় রক্ষা করবে।
মানুষটার স্নেহের কোনো অন্ত ছিল না। আমি মাঝে মাঝে পড়াশোনার শেষে (তখন আমার কলেজে
পড়ার শেষের দিক) বেশ রাত করে ওনার সাথে গল্প করতে যেতাম। রেল কলোনীতে রাত দশটা
মানে বেশ রাত। গল্প করতে করতে এগারোটা বেজে যেত, উনি আবার আমায় মাঝরাস্তা পর্যন্ত
এগিয়ে দিতে আসতেন। যত বলতাম, থাক কাকু, আর বেরোবেন না, উনি শোনার পাত্র নন।
মজার একটা ঘটনা বলি। আমাদের প্রতিবেশী একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন। এমনিতে খুব ভালমানুষ।
দোষের মধ্যে প্রচুর কথা বলতেন, আর অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেন। কোনো একটা অনুষ্ঠানে
আমাদের সবার যাওয়ার কথা কাকুর সাথে। সেখানে সেই ভদ্রমহিলারও যাওয়ার কথা। আমি
কাকুকে ডাকতে গেছি। দেখি উনি আগে থেকেই রেডি হয়ে বসে আছেন। আমি ঢুকতেই বললেন,
বোসো। আমি বললাম, কাকিমা রেডি? উনি তাড়াতাড়ি গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ রেডি। এই
একটু চাল ভাজছেন। ওটা নিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ব।
আমি তো হাঁ। যাচ্ছি অনুষ্ঠান বাড়ি। সেখানে চালভাজা নিয়ে যাওয়ার কি কারণ তো বুঝছি
না। বললাম, চালভাজা কেন?
বললেন, "আহা, ওখানে অমুক বৌদি আসবেন তো। আমাদের কথা তো বলার সুযোগ দেবেন না।
তো আমরা করব কি, উনি আসলেই ওনাকে চালভাজা ধরিয়ে দেব, উনি চিবোবেন। চিবোতে চিবোতে
গাল, মাড়ি চোয়াল সব টাটিয়ে উঠবে। ব্যস, আমাদের কেল্লাফতে! আর বকবক করে কার বাবার
সাধ্যি!" বলে 'হো হো' করে হেসে উঠলেন।
মাঝে মাঝে বলতেন, "জানো সৌরভ, আমার খুব মনে হয়, আমি রিট্যায়ার করার পর আমার
গ্রামে চলে যাব। একটা ছোটো বাড়ি বানাব। না হয় কাঁচাবাড়িই হল। সেখানে তুমি আমি
তোমার বন্ধুরা মিলে বেশ একটা ঠাকুরের পরিবার গড়ে তুলব।"
শুধু আমরা না, উনি নিজেও জানতেন এ স্বপ্নপূরণের মত সময় ওনার হাতে নেই। তবু মুগ্ধ
হতাম। সে মুগ্ধ করার ক্ষমতা ওনার চরিত্রে ছিল।
আজ বহুদিন হল উনি নেই। কারোর কিডনি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাননি। আমার ভাগ্যের পরিহাসে
আমি ওনার জীবনের শেষ মুহুর্তগুলো ওনার পাশে থাকতে পারিনি, আজও সে বিবেকের দংশনে
ভুগি। জানি উনি ক্ষমা করবেন আমায়। কিন্তু আমার এ লজ্জা কোনোদিন যাবে না। আজ ওনার
ছেলে মেয়ে দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত, শুধু সামাজিক মুল্যে না, মানুষ হিসাবেও।
ধন্য ওনার জীবন যা আজও খুব কঠিন পরিস্থিতে আমায় মনের জোর দেয়। আজও আমাদের বন্ধুদের
কথাবার্তায় 'মানকাকু' প্রসঙ্গ প্রায়ই উঠে আসে। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ এমন একজন
শুদ্ধাত্মার সাথে কয়েকটা দিন কাটানোর সুযোগ দিয়েছেন। কিছু মানুষকে কিছুতেই হারানো
যায় না। কেউই হারাতে পারে না। এমনকি মৃত্যুও না। উনি সেই দলেরই মানুষ।