Skip to main content


        মনুষ্যজাত একটাই। তার গাত্রবর্ণের, তার বাহ্যিক শব্দোচ্চারণে পার্থক্য আছে, তার দেশ-কালের নিরিখে বাহ্যিক আচরণে, প্রথায়, খাদ্যাভাসে পার্থক্য আছে। কিন্তু তার বোধ আর অনুভবের পার্থক্য নেই। সেই কথাটাই সঙ্গীত আর সাহিত্য বারবার বলে এসেছে প্রাচীনযুগ থেকে। শিল্পের এইটাই সবচাইতে বড় দায় বোধহয়, দেশ-কালের সীমারেখার ঊর্দ্ধে গিয়ে এক অবিনাশী মনুষ্যত্বের ধ্বজা বহন করা। যে বোধ না বুঝে অনুভব করা যায় তাই সার্বজনীন। তাই শান্তি, সৌহার্দ, সহমর্মিতার বিশ্বজনীন ভূমি।
        মার্কেজ আর রবীন্দ্রনাথ। দেশ-কালের নিরিখে কত দূরে অবস্থান একজনের আরেকজনের থেকে। দুজনেই নোবেল পেয়েছিলেন সেটা তাদের মিল নয়। তাদের মিল তারা আপাত পার্থক্যের আবরণ সরিয়ে আমাদের সামনে চিরকালীন সেই মনুষ্যত্বের ছোঁয়া দিয়েছিলেন। আরতির শেষে যেমন তপ্ত, জ্বলন্ত পঞ্চপ্রদীপের উষ্ণ স্পর্শের অপেক্ষায় থাকা হয় নিজেকে পবিত্র করব বলে, এও সেরকম। 
        একটা অত্যন্ত আশ্চর্জনক মিলে এই কথাটা মনে এলো। মার্কেজের আত্মজীবনীমূলক লেখা – Living to tell the tale আর রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ র কয়েকটা লাইনের মিল দেখে। মার্কেজ লিখছেন,
“My great frustration was my age when I came to Sucre. I still had three months to go before crossing the fateful line of thirteen, and in the house they no longer tolerated me as a child but neither did they recognise me as an adult, and in that limbo of my age I turned out to be the only one of my brothers and sisters who did not learn to swim. They did not know whether to seat me at the children’s table or with the grownups.”
এবার ‘ছুটি’ তে আসা যাক।
        “বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধে-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্‌ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়, লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।
        সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিংবা সখ্য লাভ করিতে পারে, তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না, কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।“

        খেয়াল করার বিষয়, এমনকি বয়েসের উল্লেখটাও এক। এই কথাটা এই মিলটা খুঁজে নিতে পারলে বেশ শান্তি, পার্থক্য কই? বৈচিত্র তো। বৈচিত্রের মধ্যে কোথাও একটা যোগসূত্র থাকে বলেই যে না একসাথে থাকার তাগিদ।