আমার ইচ্ছা করে মার্বেলের মত দেহ-মন হোক আমার। নিষ্প্রাণ সৌন্দর্য আর নিতান্ত নিস্পৃহ একটা অস্তিত্ব নিয়ে। মার্বেলের গায়ে রক্তের দাগ, পানের পিকের দাগ, ময়লা হাতের স্পর্শ... সব সমান। শীতল, সুষমামণ্ডিত মার্বেল। যেমন ঈশ্বর বসে থাকেন। নিস্পৃহ। যেমন বিগত মহাপুরুষেরা মার্বেল অবয়বে বসে থাকেন শীতল শরীর নিয়ে মন্দিরে, মঠে, দেবালয়ে।
স্নায়ু। রাখালের মত কসাই আর সবুজ ঘাসের মধ্যে তফাত খুঁজতে খুঁজতে, পালাতে পালাতে একদিন কসাইকেই ভালোবেসে ফেলে। নিস্তারের রাস্তা চেয়ে বলে, ছিন্ন করো আমাকে।
রক্ত। উন্মাদের মত, দিশাহীন। মৃত্যুর প্রাক্ মুহূর্ত অবধি হৃৎপিণ্ডের কাছে বায়না করে সারাটা শরীর জুড়ে ঘোরার, উষ্ণতায়। নিজের লবণাক্ততায়। মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে হঠাৎ সামনে দেখে দাঁড়িয়ে কাল। স্নায়ুর কাব্যগ্রন্থে উপসংহারের পালা তখন।
মহাপুরুষ বললেন, নিজেকে নিবেদন করো, নিঃশেষে। অশেষ হয়ে যাবে। নির্ভরতার মানে কি যদি নিজেকে উজাড় করে দিতেই না পারো তাঁর শরণে। তিনি পরম কল্যাণময়। আমি জেনেছি তাঁকে কল্যাণে।
কল্যাণে!
বিভীষিকাময় জগতে কল্যাণের বারুদ চাপা কোথায়? সব বিভীষিকা ধ্বংস হয়ে কল্যাণের বীজ বুনে দেবে এমন কেউ আছে? এই মহাকালের গহ্বরে তাঁর বাস?
মহাপুরুষ বললেন, তোমারই চিত্তগুহায়। সে কল্যাণের স্পর্শ। সেই স্পর্শই মানুষকে চেতনায় আলোকিত করে ভালো-মন্দের পার্থক্যে। বর্বরতা আর সাধুতার পরিচয়ে তাকে ডাকে কল্যাণগামী হতে। বেছে নিতে কঠিনকে। আত্মত্যাগে।
আত্মত্যাগ?!
নিজেকে না ছেড়ে কে পেয়েছে পথ? যখনই স্বার্থ-লোভ আকার নিয়েছে মহামারীর, তখনই উপযুক্ত সময় নিজের স্বার্থবুদ্ধি লঙ্ঘনের। নিজেকে দিতে আহুতি। প্রাণে আলো না জ্বললে মহাকালের গভীরে জেগে থাকা সমবেদনাকে অনুভব করা যায় না। সে তর্কাতীত। মায়ের প্রাণের ব্যথা তর্কগম্য নয়, সহানুভূতিগম্য নয়, নয় অনুমানগম্য। মায়ের প্রাণের ব্যথা, অনুভূত হয় আরেক মায়ের প্রাণে। তেমনই চিত্তে যদি জাগে সীমাহীন করুণার প্রাণান্তকর যন্ত্রণা, তবেই আসে আলো। সে আলো বাণীগম্য নয়। নয় সে বুদ্ধিগম্য। মর্মের যন্ত্রণায় সাড়া দেয় মরমী। তার্কিকের ক্ষুরধার যুক্তির পারে সে।
জাগুক মরম। জাগুক যন্ত্রণা। জাগুক মরমী। বুদ্ধি হোক মরমের দাস, প্রভু নয়।