Skip to main content

নন্দ ভিখারিকে বললেও সে নীলাচলে যায় না। চাল নেই, চুলো নেই, তবু নন্দকে সবাই ভালোবাসে। তার স্বভাবের জন্য। হরিনাম করে দরজায় দাঁড়ায়, যা দেবে তাই ঝোলায় নেয়, হরিনাম গাইতে গাইতে চলে যায়।

নীলাচলে যায় না। সব খরচা দেবে বললেও রাজি হয় না। তার একটাই বাসনা, রোজ একটিবার করে মহাপ্রভুর বাড়ির সামনে দাঁড়ায়, শচীমাতা আর বিষ্ণুপ্রিয়ার দর্শন নেয়, মাটিতে শুয়ে প্রণাম করে, চলে যায়।

আজ দোলপূর্ণিমা। সন্ধ্যে হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। পূর্ণচন্দ্রের আলো খোলা দরজা দিয়ে এসে উঠানে পড়েছে। সামনেই মন্দির। শচীমাতা আর বিষ্ণুপ্রিয়া গোবিন্দের বিগ্রহের সামনে বসে। প্রদীপের শিখা বসন্তের হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। গোবিন্দের সামনে নানা পদ সাজানো, সব নিমাইয়ের প্রিয়। তার জন্মতিথি যে আজ।

নন্দ উঠানের এক কোনে অন্ধকারে মিশে বসেছিল। গলাটা খুসখুস করে একটু কাশি হল। মায়ের কানে গেল। শচীমাতা বললেন, বাবা নন্দ এসেছিস? সামনে আয়, অন্ধকারে বসে কেন রে, বয়েস হয়েছে, চোখে ভালো দেখি না রে।

নন্দ উঠে এসে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করল। বসল। তার চোখ ছলছল করে উঠল। বলল, মা তোমার নিমাইয়ের বিশ্বসংসারের উপর এত দয়া… আর তোমরা দু'জন প্রাণী…..

গলা ধরে, কথা আটকে গেল। পাশের নিমগাছে কোকিল ডেকে উঠল একটা। দূরে মাঠে বাচ্চাদের খেলার আওয়াজ ভেসে আসছে।

শচীমাতা বলল, সেকি আমাদের একার রে… সে তো গোটা সংসারের….

নন্দ বলল, তোমার যে না এ ব্যাখ্যায় গর্ব হয়, তোমার ছেলে, তার এত নামডাক… কিন্তু এ… মা জননীকে দেখলে আমার বুক ফেটে যায় মা… কি নিষ্ঠুর তোমার ছেলে গো… এমন সোনার প্রতিমা ফেলে… কেন গো… এখানে বসে জগৎ উদ্ধার হয় না?

বিষ্ণুপ্রিয়া একটা শালপাতায় প্রসাদ তুলে এনে নন্দ'র হাতে দিল। বলল, দাদা, তোমার বয়েস হয়েছে, কেন মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছ বলো…. তুমিও কি সারাজীবন সুখে কাটালে? আমার ভাগ্যে নেই সুখ…. তুমি তার কি করবে বলো?

নন্দ বলল, এ তোমার ছেলেভোলানো কথা মা জননী…. তুমি হলে লক্ষ্মী….

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, একই অঙ্গে সে রাধামাধব… জানো তো…. প্রতিটা কণায় আমার মধ্যে মিশে সে…. আমার থেকে আলাদা করে তাকে কার সাধ্যি?

নন্দ বলল, এ তোমার মুখের কথা…. সেকি তোমার কথা ভাবে? তোমাকে মনে পড়ে না তার?

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, তার নিজেরই কি নিজেকে মনে থাকে? শুনেছ না সে রাজার ডাক ফিরিয়ে দিয়েছে? পণ্ডিতের অহংকার খর্ব করেছে, নিজের পাণ্ডিত্যাভিমানটুকু অবধি জলাঞ্জলি দিয়েছে… নইলে তার টোলে কিসের অভাব ছিল বলো তো দাদা?…. না ছিল মানের অভাব, না ছাত্রের…. তবে?

নন্দ বলল, তোমার কষ্ট নেই?

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, বুকফাটা কষ্ট আছে দাদা… কিন্তু অপমান নেই…. নিজেকে হতভাগ্য মনে হয়েছে….. কিন্তু বঞ্চিত মনে হয়নি…. কাঙাল মনে হয়েছে… কিন্তু শূন্য মনে হয়নি….. এত এত মানুষের কান্না যার বুকে বেজেছে… তার বুকের মধ্যে কি আমার বিন্দুমাত্র জায়গা নেই? আছে। সব আছে। আমার সর্বস্ব ঘিরে তো শুধু সে-ই আছে। আর যদি বলো সুখ…. সেকি নিজেই সুখী? তার কীর্তনে সে কি প্রবল আকুতি শোনোনি নন্দদা? তার নামসংকীর্তনে পুত্রহারা মায়ের মত কান্নার আওয়াজ পাওনি? আমি পেয়েছি। সে যে প্রতিদিন তিল তিল করে পুড়ে শেষ করে দিচ্ছে নন্দদা নিজেকে…আমার কি স্বার্থপরের মত শোকের কান্না নিয়ে পড়ে থাকলে চলে? প্রদীপের শিখার যে তাপ তা প্রদীপের মাটির শরীর সহ্য করে নেয় বলেই শিখা নিজেকে নিশ্চিন্তে পুড়ে ছাই করে। প্রদীপের শিখা আর সলতের ছাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গা-টাও যে পুড়ে কালো হয়ে যায় দাদা। এই তো নিয়ম।

নন্দ বিষ্ণুপ্রিয়াকে প্রণাম করে, শচীমাতাকে প্রণাম করে প্রসাদ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শচীমাতা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, গর্ব আমার হয় নন্দ, সে আমার ছেলে বলে, এত মানুষের যে আশ্রয় তাকে পেটে ধরেছি বলে… কিন্তু কি জানিস… সে গর্ব এ চাঁদের আলোর মত…. নরম… সে আমার গর্ভ আশ্রয় করেছে বলে আমি ধন্য রে…. নইলে আমার সাধ্য কি বল, যে রাজাকে ফিরিয়ে দেয়, আমি মূর্খ নারী তাকে কান ধরে শাসন করি…. সে আমার অবাধ্য হয়নি…. আমার সাধপূরণ হয়নি বলে কি তাকে নিষ্ঠুর বলা সাজে রে….. আমার কষ্ট হবে বলে সে তো পুরীতেই থেকে যাবে বলল…. এখানের লোক সেখানে যায়… আমি তার খবর পাব বলে…. এও কি কম রে! সূর্যকে কি দাওয়ায় বসিয়ে আলো দিতে বলা যায়? তাকে তো ছেড়েই দিতে হয়… নইলে যে জগত অন্ধকার….

নন্দ বলল, সে কি ধাতুতে গড়া আমি জানতে চাই না মা…. সে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে… কিন্তু তোমরা দু'জন কি ধাতুতে গড়া… মা আমার জানতে ইচ্ছা করে… কোনোদিন যদি গোবিন্দ আসে সামনে… আমি বলব তুমি আমায় বৈকুণ্ঠধামে নিয়ে যেও না… আমার দুই মাতা যেখানে যাবে তুমি আমায় সেখানেই নিয়ে যেও….. আর গোবিন্দকে বলব, তুমিও ঋণী থেকো এ মিশ্র বাড়ির উঠানের কাছে…. আমার দুই মায়ের কাছে…..