লতা
======
প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে প্রতিটা মানুষ যা নতুন করে শেখে, জানে তা বিশ্বসংসারের কাছে আদতে পুরানো। যে শিশু হাঁটতে শিখছে আর যে মানুষটা মৃত্যুর পায়ের শব্দ সারা শরীর জুড়ে অনুভব করছে, এই দুই তাদের কাছে প্রথম, নতুন। কিন্তু বিশ্বের কাছে চিরকালের।
লতা বর্ধমান স্টেশানে বসে এই কথাগুলো ভাবছিল। এইভাবে আগে ভাবত না। এখন ভাবে। ইদানীং ভাবে। বয়েস একান্ন। কিন্তু পঞ্চাশের দোরগোড়াতেই ধরেছে ক্ষয়রোগে। আরো অনেক রোগ। শরীরে শিকড় ছাড়িয়ে মনের মধ্যে ডালপালা মেলে বসেছে। তার কোনো একটা ডালে বসে গাইছে যমের পাখি। লতার চোখ বন্ধের অপেক্ষায়।
তার পাড়ার মেয়েরা বলে বুড়ো বেশ্যার ছলের অভাব হয় না। কথাটা হয় তো সত্যিই। দেশভাগের পর কত কি হল। এখন ভাবতে গেলে গুলিয়ে যায়। বর্ধমান থেকে বাসে ঘন্টা দেড়েক গেলে নিতাইপল্লী। সেই পল্লীর বুড়ো শিবতলার পাশেই তাদের বাস। তাদের মানে, বেশ্যাদের। সবাই ওপারের। মূলহারা। কেউ আর মূল খুঁজতেও যায় না। মূলের সঙ্গে অনেক মুখ, অনেক কান্না, অনেক রক্ত, অনেক স্বপ্নের হতশ্বাস। কে খোঁড়ে?
লতা কাশী গিয়েছিল। ছিল মাস ছয়েক। চুল ফেলে এসেছে। এখন মাথায় ছোটো ছোটো কাঁচাপাকা চুল। চেহারা এখনও স্থূলত্ব ছাড়েনি। তবে ছাড়বে। ভাঙবে। বিনা আর্তনাদে সব খসে খসে পড়বে। লতা জানে। দেখেছে। পা-টা অল্প অল্প ফুলেছে। টোপা হয়ে আছে। আঙুল দিলে ডেবে যায়। ডাক্তার বলে যকৃতের দোষ হয়েছে। হতে পারে। মাল কম গিলেছে সেই তেরো বছর বয়েস থেকে! লতার আফসোস নেই। একটা ব্যথা আছে। অনুপকে না ফেরালেই পারত।
লতার তখন বেশ খ্যাতি। অনুপ ছিল বর্ধমানের ঘোষবাবুর মেজোছেলে। বংশপরম্পরায় চালের ব্যবসা ওদের। রামপুরহাটে আদি বাড়ি। সেখানেই নিয়ে গিয়ে রাখবে বলেছিল লতাকে অনুপ। লতা রাজি হয়নি। কেন হয়নি সে লতার কাছেও স্পষ্ট নয়, আজও ভাবতে গেলে কেমন ধোঁয়াশা লাগে। অনুপ সুপুরুষ ছিল না। কিন্তু মনটা ভালো ছিল। মানুষ ঘর করে তো মনের সাথে, শরীরের জোয়ার ভাটা আর ক'দিনের? কিন্তু আজ যতটা স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারে লতা, সেদিন পারেনি কেন?
চা তেষ্টা পাচ্ছে। জপ হয়নি। চা খাবে? খুব মেঘ করে এসেছে। শ্রাবণ কাশী থেকে কাটিয়েই এসেছে। এ ভাদ্রের মেঘ। উঠে চা নিয়ে এলো লতা। চাওয়ালার চোখের দিকে তাকালো, চেনে তাকে? খদ্দের ছিল সে কোনোদিন? বয়েস তো হয়েছে তার দেখেই মনে হচ্ছে। তবে লতার এই পোশাকে হয় তো চিনবে না। সব পুরুষ ওপাড়ায় যায় না তো। কারা যায় আর কারা যায় না, লতা আগে মুখ দেখলেই বুঝতে পারত। এখন পারে না। আগে মনে হত পাপের রাস্তায় সবাই চলেছে হাতে হাত ধরে সাথে সাথে। বয়েস যত বাড়ল, মনে হল সবাই না। সে একাই চলেছে এই পাপের রাস্তায়। হঠাৎ সেদিন তার মনে হল ঈশ্বরকে তার দরকার। মনে সত্যিকারের ভক্তির রং ধরল না, কিন্তু বাইরে ধর্মের প্রলেপ পড়ল। লতা বদলে গেল। কাজের মেয়েরা বলল, ঢং। কেউ বোঝে না তাকে, এক উমাকান্ত আর সুফলদা ছাড়া।
মনে মনে মহাদেবকে স্মরণ করে, জপের মালা আর গুরুদেবকে স্মরণ করে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চোয়ালগুলো টাটিয়ে উঠল, এতক্ষণ না খাওয়া। বন্যার মত লালার স্রোত নামছে মুখ বেয়ে। চোয়াল যেন পাহাড়ের ঢাল। একটা বিস্কুট খেতে হবে। নইলে এখনি পেটের উপরের দিকটা টাটিয়ে উঠবে। গা গুলাবে।
আবার চাওয়ালার মুখের দিকে তাকালো। তার দিকে তাকাচ্ছে না কেন? আগে গা-পিত্তি জ্বলে যেত লতার কোনো পুরুষ যদি তার মুখের দিকে, তার শরীরের দিকে না তাকাতো। মনে মনে বলত, নপুংসক, হিজড়ে শালা। আজ বলতে ইচ্ছা করল না। আজ তো সবাই সাধু। সব মধু খেয়ে নিয়ে এখন সংসার সাদা। সে-ই শুধু পাপের গলা জলে দাঁড়িয়ে। সে মরলে সংসার শুদ্ধ হয়।
বিস্কুটে কামড় দিল। আজকাল স্বাদ পায় না জিভে ভালো। তিতো লাগল। এখন তাই লাগে বেশিরভাগ সময়। একটু সিদ্ধভাত আর পোস্তবাটা খেতে ইচ্ছা করছে। খিদে পাচ্ছে। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাঁড়টা লাইনে ফেলে দিল। একটা মালগাড়ি ধোঁয়া উড়িয়ে হাওড়ার দিকে চলে গেল।
লতা জপের মালাটা বার করল। সিটে হেলান দিয়ে বসে জপে মন দিতে গেল। চোখে ভাসছে কাশীর ঘাট। অর্ধনগ্ন পুরুষের দল। তার দিকে তাকাচ্ছে। তার যে শরীরের ভাঁজ লণ্ঠনের আলোয় পুরুষজাতের মাথা খেত, পাগল করে দিত, সেই খাঁজভাঁজ নিয়ে শরীর ডুবছে গঙ্গাজলে। শুদ্ধ হতে। গঙ্গা দু'হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিচ্ছে তাকে। অনেকবার মনে হয়েছে ডুবে যায়। দড়ি-কলসীর অভাব বাঙালি মেয়েদের আর কবে হয়েছে? দেশভাগের পর কত মেয়ে যমের দুয়ারে নিজেকে পাঠিয়ে নিজেকে বাঁচিয়েছে সে যমরাজই জানেন। আর জানে সুফলদা। সুফলদা রাজনীতি করে। কত কত খোঁজ রাখে। মানুষটাকে দেখলে শ্রদ্ধা জাগে। তাদের জন্যেও অনেক করেছে। ডাক্তারের ব্যবস্থা। বন্যার সময় সুফলদা না থাকলে বাঁচত তারা? কিন্তু সুফলদা হাজার হোক পুরুষ তো, তাই চোখের খিদে আটকাতে পারে না। কিন্তু কোনো কারণে লতার কাছে নিজেকে খুলে ধরেনি। অন্য ঘরে রাত কাটিয়েছে। তার ঘরে আসেনি। সুফলদার বউকে দেখেছে লতা, খবরের কাগজে। সে-ও রাজনীতি করে। ওরা বলেছে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হলে ওপার বাংলার মানুষদের আর দুঃখ থাকবে না। দণ্ডকারণ্যে যারা আছে সবাই ফিরে আসবে। ঘর পাবে। সংসার পাবে। ভালো লাগে এসব ভাবতে লতার। সবাই কি আর খড়কুটোর মত ভেসে যায়?
লতার আঙুলে কেন্নোর মত জপের মালা ফিরে চলতে চলতে থেমে গেছে। লতা ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বপ্নের মধ্যে লতা দেখছে তার মা বড়ি দিচ্ছে, লতা পিছনে বসে বসে মায়ের চুল নিয়ে খেলা করছে। লতার চোখেমুখে প্রসন্নতার ছাপ। লতা এখনও যখন তার ভাষায় কথা বলে, তার মনে হয় যেন মায়ের পানে রাঙানো ঠোঁট তার কথার উপর বুলিয়ে যাচ্ছে। লতার মাঝে মাঝে কান্না পায়। একা কাঁদতে ভালোবাসে বরাবর সে। লতা অপেক্ষা করছে উমাকান্ত'র জন্য। উমাকান্ত'র তাকে নিতে আসার কথা। সুফলদার গাড়ি নিয়ে।
উমাকান্ত
=======
উমাকান্ত'র মা মারা যায় কলেরায়। বাবা বিবাগী হয়। ঠাকুমা মারা যায় ঈশ্বরের হাতে রেখে উমাকান্তকে যখন তার বয়েস চোদ্দো। স্কুলের পালা চুকিয়ে কি করে যে সে বুড়ো শিবতলার এই খারাপ পল্লীর ছোকরা হয়ে উঠল, সে বুঝলই না। তার গায়ের রঙ সাদা। ছিপছিপে গড়ন। চোখদুটো সব সময় যেন উদাস, কান্না কান্নায় ভরা। উমাকান্ত ধীরে ধীরে হয়ে উঠল দালাল। মাঝে মাঝে কবিতা লেখে। গান গায়। বিয়েও করল। কিন্তু সংসার করে উঠতে পারল না। বউ তার এক ছেলে নিয়ে থাকে বাঁকুড়ায়। সেলাই শেখায়। উমাকান্তের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেড়ে গেছে। উমাকান্ত আর ওমুখো হয় না। ওরাও আর খোঁজখবর রাখে না।
লতাকে উমাকান্ত খুব শ্রদ্ধা করে। কেন করে জানে না। লতাকে দেখলে তার কোনোদিন পাপ ইচ্ছা জাগে না। হয় তো মানুষ নিজেকে পুরোটা প্রবৃত্তির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না বলেই কিছুটা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় বিবেকের হাতে। লতাকে ঘিরে থাকত উমাকান্তের বিবেক। লতার উচ্ছৃঙ্খল জীবন। লতার ঝড়ের মত মেতে থাকা উমাকান্তকে কষ্ট দিত। মাঝে মাঝে খুব অভিমান হত। যেত না তার দিদির ঘরে। আবার মান ভাঙত। আবার যেত।
একদিন খবর এলো তার বউ আর ছেলে আগুনে পুড়ে মরেছে। এক রাতের মধ্যে বদলে গেল উমাকান্ত। নিজের মধ্যে যে একটা গোপন সংসার সে এইভাবে লালন করত তা কে জানত? উমাকান্ত বদলে গেল। সারাদিন নেশার ঘোরে থাকত। স্বভাবে বিকার ঢুকতে শুরু করল। যে মেয়েরা তাকে আশ্রয় দিত, তার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতো, তারাই তার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে শুরু করল। একবার এক নতুন মেয়ের পাছায় সিগারেটের ছ্যাঁকা দিল উমাকান্ত। সেদিন প্রথম ওর গায়ে হাত তুলেছিল লতা। অনেকবার মনে হয়েছে তাকে মেরে বার করে দেয়, কিন্তু পারেনি লতা। নিজেকে সংযত করে রেখেছিল। কিন্তু সেদিন আর পারল না। মেরে তার চোয়াল ফাটিয়ে রক্ত বার করে দিয়েছিল। তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর নিজের ঘরে দরজা দিয়ে দু'দিন না খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল।
উমাকান্ত পর্ব এখানেই শেষ হল না। ক'মাস পর থেকেই খবর আসতে লাগল সে এমন সব কাজ শুরু করেছে বর্ধমানে যে, যে কোনোদিন খুন হয়ে যাবে। টাকা ধার নেওয়া, সারাদিন মদ খেয়ে রাস্তায় ঘাটে পড়ে থাকা --- একদিন সবটা অসহ্য হয়ে উঠল লতার কাছে। সুফলদাকে নিয়ে রওনা হল উমাকান্তকে ফিরিয়ে আনতে। সুফলদার জন্যেই খোঁজ পেতে অসুবিধা হল না লতার। একটা বস্তিতে থাকছিল সে। লতা তাকে যে অবস্থায় দেখল, তার গলা বুজে এলো কান্নায়। নিজেকেই দোষী মনে হল উমাকান্ত'র এই অবস্থার জন্য। উমাকান্ত তখন সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ নয়। তবু ওই যে বলছিলাম বিবেকের কথা, শরীরের নাভি যেমন কিছুতেই গোটাটা পোড়ে না, তেমনই বিবেককেও সম্পূর্ণ উৎখাত করে নিজের চেতনা থেকে এমন ক্ষমতা মানুষের হয় তো নেই। উমাকান্ত লতার পায়ের উপর পড়ে কাঁদতে শুরু করল বাচ্চাদের মত।
উমাকান্ত ফিরল। লতা চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। চিকিৎসক বিধান দিলেন ওকে রাতদিন আফিম খাইয়ে নিস্তেজ করে রাখতে। ওর মনে, শরীরে বাসা বেঁধেছে পাপপুরুষ, চিকিৎসক বলল। লতার বিশ্বাস হল না। কিন্তু আশু কোনো উপায়ও দেখল না। এরপর থেকে বড় কোনো গোলমাল উমাকান্তকে নিয়ে হয়নি। তার মাঝে মাঝে একজন মেয়েমানুষ লাগে, আর কবিতা লেখার খাতা। সে কবিতা শুনলে কান লাল হয়ে যাবে ভদ্র মানুষের। লতা বলে মানুষের যেমন বদরক্ত বেরিয়ে যায়, তেমনই ওর ভিতরে বাসা বাঁধা পাপপুরুষের লালসা এগুলো। আজকাল অবশ্য উমাকান্ত হিন্দি ভাষাতেই সব লেখে। কে জানে নিজের ভাষায় এই নোংরা কথাগুলো লিখতে হয় তো বাধে কোথাও।
ক্রমে উমাকান্ত যে বেঁচে আছে সে কথাই মনে থাকত না অনেকের। তার খাওয়ার সময় খাওয়া পৌঁছাতো না। রোগের ওষুধ পৌঁছাত না। সবার কাছে সে হয়ে উঠল এক বালাই। এমন সময় লতার রোগের সূচনা। উমাকান্ত কি করে টের পেল লতা বোঝে না। সে যেন বুঝল লতার দিন ফুরিয়ে আসছে। উমাকান্ত ধীরে ধীরে নিজেকে লতার কাছাকাছি নিয়ে এলো আবার। চেষ্টা করতে শুরু করল স্বাভাবিক ব্যবহার করার। সুফলদাকে বলে লতা অনেক আগেই ড্রাইভারিটা শিখিয়েছিল, যদি একটা কাজ পায় বলে। সুফলদার গাড়িও চালিয়েছে কয়েক মাস। কিন্তু পারেনি স্বভাবের দায়ে। ছেড়ে দিয়েছিল।
লতাকে বর্ধমান স্টেশান থেকে কাশীর ট্রেনে তুলে দিতে সুফলের গাড়ি নিয়েই এসেছিল উমাকান্ত। কথা দিয়েছিল সে-ই আবার নিতে আসবে। যখন ট্রেনে বসিয়ে জানলার কাছে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করছিল উমাকান্ত, লতা দেখেছিল ওর চোখের কোণা ভিজে। লতা জানত না, সে শুধু লতার দিন ফুরানোর খবরই টের পায়নি। নিজেরটাও পেয়েছিল। লতার ফেরার ট্রেনের কথা টেলিগ্রামে আসার দু'দিন আগেই সে তার ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পাড়ি দিয়েছে। লতা জানত না সে কথা। সুফল আসছে তাকে নিতে।
সুফল
=====
সুফলের জন্ম ভট্টাচার্য্য বাড়িতে। বাবা যজমানী করতেন। মা ঘর সামলাতেন। ছোটোবেলায় সুফলের আস্তিকতা ছিল জন্মপ্রাপ্ত। স্কুলে পড়তে পড়তে তার ঈশ্বরে বিশ্বাস পাতলা হয়ে গোস্পদে জমা জলের মত হয়ে দাঁড়ালো। সে শুধু ক্ষীণ নয়, ঘোলাও। কলেজে পড়তে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। স্বঘোষিত নাস্তিক হল। নাস্তিকতাকে অস্ত্র করে প্রথমে বিশ্বজয়, পরে ভারত জয়, অবশেষে বর্ধমানটুকু জয় করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত। ভালো বক্তা। মোটামুটি লেখে ভালো। শিক্ষিত সমাজে অল্প অল্প পরিচয় বাড়তে শুরু করল।
সুফলের বিয়ে হল কলেজের এক প্রফেসারের মেয়ের সঙ্গে। রাজনীতি সূত্রেই পরিচয়। অনুশ্রীর রাজনীতির শিক্ষা বাড়ি থেকেই। বিয়ের পর সুফল বুঝল তার রাজনীতির বিশ্বাসের মধ্যে একটা ফাঁকি আছে। তার নাস্তিকতা তার পরিবারের আস্তিকতার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। বাবা ভালো চাকরি ছেড়ে যজমানি করে সংসার চালাতেন। কোনোদিন অবস্থা সচ্ছল ছিল না। মা বলতেন, ঠাকুর্দা মারা যাওয়ার পরই নাকি বাবার মাথায় এই ভূতটা চাপায় যজমানেরা। তারা বাবাকে বোঝায় শ্রীযুক্ত নরেশ ভট্টাচার্য্যের মৃত্যুতে তারা অকুলে ভেসে যাবেন। কে তাদের পথ দেখাবে তার সুযোগ্য একমাত্র পুত্র সজল ভট্টাচার্য্য ছাড়া। সজল ভট্টাচার্য্য মানে সুফলের বাবা। রেলের বড়বাবুর চাকরি এক কলমের খোঁচায় ছেড়ে দিলেন সজলবাবু। সুফলের তখন আড়াই বছর বয়েস। সুফলের মা অনেক কান্নাকাটি করেও সজলবাবুকে ফেরাতে পারলেন না তার সিদ্ধান্ত থেকে। সজলবাবু আশ্বাস দিলেন রেলে যা না মাইনে পেতেন তার চতুর্গুণ আয় করে দেখিয়ে দেবেন। দরকার হলে কলকাতায়, শিলিগুড়িতে আরো যজমান বাড়াবেন।
জানি না ওনার স্ত্রী বিশ্বাস করেছিল কিনা। কিন্তু বাস্তব হল ভিন্নরূপ। যজমানি শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই কি এক ভোলা রোগে ধরল। সব ভুলে যেতে শুরু করলেন সজলবাবু। প্রথমে সবাই ভেবেছিল বাবার মৃত্যু, চাকরি ছেড়ে নতুন কাজের চাপ, এইসবে হয় তো হচ্ছে। ক্রমে দেখা গেল তা নয়। মন্ত্র ভুলে যাচ্ছেন। পুজোর উপাচারে গোলমাল হচ্ছে। বাড়ি ফেরার রাস্তা ভুলে যাচ্ছেন। সুফল কতবার শিয়ালদহ, হাওড়া, ভুবনেশ্বর, কোচবিহার এইসব জায়গা থেকে বাবাকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসেছে। বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল যেন সে। তারপর একদিন আর ফিরলেন না সজলবাবু। বহুমাস পরে বেণারস স্টেশানে বেওয়ারিশ লাশের মধ্যে পাওয়া গেল সজলবাবুকে।
সুফল তার এই যন্ত্রণাবহুল ফেলে আসা জীবনের জন্য একমাত্র দায়ী করে ঈশ্বর আর ধর্মকে। কিন্তু কে জানত যে তার প্রাণের গভীরে ধর্মের জন্য এক আকুতি, ঈশ্বরের জন্য এক ছটফটানি সে সব সময় বয়ে নিয়ে চলে। এইদিকটা সে জানতে পারল অনুশ্রী তার স্ত্রী হয়ে আসার পর। অনুশ্রীর নাস্তিকতাটা বুদ্ধিজাত। স্বাভাবিক। তার ঈশ্বর বা ধর্ম নিয়ে না আছে কোনো আক্রোশ, না উৎসাহ। তাকে সুফলের মা অঞ্জলি দিতে বললে সে দেয়। লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে বললে সে পড়ে। কিন্তু মনেপ্রাণে সে এসবের ধার দিয়ে যায় না, সে সবাই জানে। কিন্তু কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলে না।
এই পার্থক্যটা যত তীব্র হতে শুরু করল সুফল তত নিজেকে দলের সাংগঠনিক কাজ থেকে সরিয়ে এনে সমাজসেবার কাজে যোগ দিল। সেই করতে গিয়েই তার লতার সঙ্গে আলাপ। আলাপের দু'দিনের মধ্যেই বুঝেছিল যে লতার প্রাণেও ঈশ্বরের উপর এক তীব্র বিদ্বেষ আছে। ধর্মের ভেদের জন্য যাকে সংসারে এই আস্তাকুঁড়ে এসে পড়তে হয় নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে সে ধর্মের প্রতি দ্বেষ রাখবেই, এতে সুফল অবাক হওয়ার মত কিছু দেখল না। লতা তাকে দাদা বলে ডাকল। সুফল সাড়া দিল। কিন্তু মন থেকে মেনে নিল না ডাকটা। লতাকে দেখলে তার বুকের ভিতরটা টাটায়। চেপে রাখে। তার নিজের তৈরি নিজের ভাবমূর্তিতে লাগে। ক্রমে অনুশ্রীর সঙ্গে সুফলের মানসিক দূরত্ব বাড়তে লাগল। অনুশ্রী তাকে করুণা করে। তার দুর্বলতাগুলোকে ঢেকে রাখে সে বুঝতে পারে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার মত কিছু পায় না। এত করুণায় বাঁচে কি করে মানুষ? অনুশ্রী সংসার চালাতে একটা স্কুলে জয়েন করল। মাইনে বেশী না। চলে যায়। সুফল আরো বেশী করে সামাজিক কাজে জড়িয়ে ফেলল নিজেকে। প্রায় বাড়ি ফেরে না। নিজের মধ্যে একটা সুতোছাড়া ভাব সারাদিন। ক্রমে নিজের বিশ্বাস, আদর্শ গুলিয়ে যেতে শুরু করল। কিসের তাগিদে এ রাস্তায় আসা মনে পড়লেও ভিতর থেকে কোনো সাড়া পেত না। যুক্তিগুলো গুলিয়ে যাচ্ছিল। নিজের সঙ্গে নিজের মধ্যে রাতদিন তর্ক। মাথা ছিঁড়ে যেত। লতার কাছে সুখ চাওয়া যায় না। সেই সময় আশ্রয় দিল ওই পাড়ার অন্য মেয়েরা। দু-একটা ঘরে রাত কাটানো প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল।
এখন সুফলের জীবন নদীর ধারে ফেলে যাওয়া ভাঙা পাত্রের মত। কখনও জল ঢুকে বসে থাকে। কখনও জল শুকিয়ে কাদা। কখনও ব্যাঙ। কখনও সাপ। জলের ঢেউ বারবার ধুয়ে ধুয়ে যায় সে ভাঙা পাত্রের গা। ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। সুফলের জীবনও তেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে সময়ের ঢেউয়ে। অনুশ্রী কলকাতায় থাকে। তারা সন্তান নেয়নি। অনুশ্রী বলে তাদের জীবন আদর্শের জন্য। ওসবের সময় নেই। সুফলের যুক্তিটা হাস্যকর মনে হলেও সিদ্ধান্তটায় অসুবিধা হয়নি। একজন ব্যর্থ বাবা হওয়ার দায় কে নেবে? সেকি আবার একটা সজল ভট্টাচার্য হবে নাকি?
লতা আর সুফল
============
কাকভেজা হয়ে সুফল স্টেশানে এসেছে। তার সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি ভিজে চাপচাপ হয়ে আছে। লতাকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। লতা আর সুফল পাশাপাশি বসে।
লতার মুখের দিকে তাকালে মনে হবে যেন কালবৈশাখী চলে যাওয়া কলাবাগান। এইমাত্র সে উমাকান্ত'র চলে যাওয়ার খবরটা পেল। কোনো কথা জিভ অবধি আসছে না। কথাগুলো মাথার মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ঘূর্ণী তুলে কোন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সুফলও কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। এই লতা যেন তার পরিচিত লতা নয়। এ যেন হেরে যাওয়া, কাদার তালের মত একটা মাংসপিণ্ড। মানুষ হেরেই যদি যাবে তবে এত লড়াই কেন করে? অবশ্য হেরে যাওয়ার বীজটা তো বুকের মধ্যে নিয়েই ঘুরছিল সে আর লতা। খাঁটি হতে পারেনি তো বিশ্বাসে, জীবনে, ভালোবাসায়।
লতা মাটির দিকে তাকিয়েই বলল, তুমি ফিরে যাও সুফলদা, আমি আর ফিরব না।
সুফল চমকে উঠে বলল, ফিরবে না মানে? কোথায় যাবে?
লতা বলল, জানি না। বিশ্বনাথের এত বড় বিশ্বে আমার মত একটা জীবের জায়গা হয়েই যাবে। কিন্তু ফিরে কি করব বলো? কার জন্য ফিরব? যেটুকু টান সংসারে অবশিষ্ট ছিল সে ওই চালচুলোহীনটার জন্য... সেই যখন মায়া কাটিয়ে..., গলা বুজে এলো লতার। দু-ফোঁটা চোখের জল তার হাতে ধরা জপের মালায় পড়ল।
সুফলের রাগে, অভিমানে বুকটা ঝলসে উঠল যেন। সে বলল, আমি তোমার কোনোদিন কেউ ছিলাম না বলো…
গলার সুরটা অচেনা হলেও ভাবটা অচেনা নয় লতার কাছে। সে বলল, তা কেন? তুমি ছিলে বলেই এই পাপের জীবনটার একটা গতি হয়েছিল…
থাক থাক... আমি সারাটা জীবন কি পেলাম বলো তো? ভিখারিরও নিজের একটা পরিচয় থাকে নিজের কাছে নিজের... আমার সেটুকুও নেই... সারাটা জীবন শুধু ভাণ করে কাটিয়ে গেলাম…
এই কথাগুলোর মানে লতা বুঝল না। বুঝতে চাইলও না। যত দিন যাচ্ছে সংসারে আগ্রহ তার তলানীতে এসে ঠেকেছে। একটা ট্রেন ঢুকছে এই প্ল্যাটফর্মে।
এটা কোথায় যাচ্ছে দাদা? একজন যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করল লতা। উত্তর পেল, দিল্লী।
লতা হঠাৎ উঠে ঝুঁকে সুফলের পায়ে হাত দিয়ে বলল, আমি আসি দাদা। দেখি বৃন্দাবনে রাধামাধবের পায়ে যদি ঠাঁই পাই তবে নিজেকে ধন্য মনে করব।
সুফল দাঁড়িয়ে পড়ল। তার গাল বেয়ে নামছে চোখের জল। লতা তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলতে গেল, বলতে পারল না। সুফলও পারল না। দু'জনেই নিজেদের মনের মধ্যে আধা বিশ্বাসে আর আধা সংশয়ে জাগা ঈশ্বরের কাছে দু'জনকে সমর্পণ করে বলল, শান্তি পাও।
ট্রেন ছাড়ল। লতা তাকিয়ে আছে বৃষ্টিভেজা সুফলদার দিকে। এই সংসারে তার মত এক বৃদ্ধা বেশ্যার জন্য চোখে জল আসে এমন একজন মানুষও আছে, এই না কত!
সুফল ঝাপসা হয়ে এলো। দূরত্বের জন্য না, চোখের জলে ভিজে।