রাস্তা শেষ হল। জোনাকি জ্বলছে। ঝিঁঝি ডাকছে। মানুষ কই? কেউ নেই। দূরে স্টেশান। শেষ ট্রেন চলে গেছে। লাল সিগন্যাল। লাল মানে বারণ। কেউ যাবে না।
গোঁসাই ভাবল স্টেশানে গিয়ে বসে। কিন্তু এই ফাঁকা রাস্তা। পাশে দীঘির জল। ঠাণ্ডা বাতাস, জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। গোঁসাইয়ের সন্ধ্যে থেকে ভিক্ষা জোটেনি। যা হোক, না জুটুক। গোবিন্দের ইচ্ছা। সামান্য একটু মুড়ি ছিল। তাই খেয়ে একতারাটা বার করল। নাম গাইবে। নিঃসহায়ের সম্বল নাম ছাড়া আর কি? নাম মানেই প্রেম। প্রেম মানেই নাম। প্রেম মানেই সত্য। সত্য মানেই প্রেম। একতারায় সুর উঠল। নাম, প্রেম, সত্য - এক হল।
গোঁসাইয়ের চোখ বন্ধ। চোখের কোল বেয়ে নামছে জলের ধারা। হঠাৎ শুনল চুড়ির আওয়াজ। কে?
আমি গোঁসাই।
কে তুমি মা?
মা! মা নই গো। খারাপ মেয়েমানুষ। আমার মানুষটা মরতে বসেছে। আমি যাই, রাতে খাইয়ে আসি। সে না মরলে আমি মরতে পারি না। আবার সে আছে বলে আমার বেঁচে থাকাটাও দুঃসহ।
গোঁসাই বলল, থাক থাক মা, ওসব কথায় কাজ নেই। পাঁকে কেউ ইচ্ছা করে পড়ে না। কিন্তু পাঁকে পড়ে থাকাটাই শেষ কথা না। পাঁক থেকে ওঠাটাই আসল।
তোমার সমাজ দিলে তো….
সমাজ থাক। সে তো আমারও নেই। আমার আছে নাম, প্রেম আর সত্য - গোবিন্দ।
তোমার মান আছে গোঁসাই.. আমার নেই… তুমি পারিজাত, আমি বিষফল।
মানের আমি থোড়াই পা চাটি রে মা.. তবে এই আধপেটা খেয়ে এই দীঘির ধারে রাতে কি করি… তোদের গাঁয়ে তো বৈষ্ণবসেবার ঢল আছে… কিন্তু আমারও মনে ধরে না… আমার গোবিন্দের কাছে পারিজাত আর বিষফল দুই-ই সমান… গোবিন্দ যখন শিব তখন সে নীলকণ্ঠ।
আমার বিষও ধরবে?
অমৃত আর বিষ দুই-ই যে তার। সে ধরবে না তো কে ধরবে মা?
মল্লিকা উঠে এলো। হঠাৎ গোঁসাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি খারাপ ঘরের ছিলাম না ঠাকুর… আমি… জেনেশুনে এ রাস্তায় আসিনি…
গোঁসাই বলল, ওঠ… ওঠ….
মল্লিকা বলল, আমায় দীক্ষা দাও গোঁসাই…
গোঁসাই বলল, দীক্ষা আমি দিই না। আমি বিশ্বাসও করি না। যাকে ভালোবাসছিস বাস, কিন্তু গোবিন্দের সন্তান জেনে বাস… যা ভাবিস.. যা জানিস, দেখিস, শুনিস গোবিন্দকে সত্য জেনে কর… সব ঠিক হয়ে যাবে…. গোবিন্দের উপরে কাউরে বসাস না… পুড়বি…
মল্লিকা বলল, আমার যে বিশ্বাস টলে যাবে আবার…
গোঁসাই বলল, গোবিন্দই ফিরিয়ে আনবে… বিশ্বাস ভাঙলে যে অবিশ্বাস জন্মায় সে অন্ধকার… সেখানে শান্তি নেই, তাই স্থিতি নেই…. মানুষ আবার বিশ্বাস খোঁজে… সরল বুদ্ধিতে চাইলে পায়… মতলব আঁটলে আবার গুলায়… তুই তো ভালোবাসা মানে জানিস… শুধু গোবিন্দের দিকে মোড় ফিরিয়ে দে… সব ঠিক হয়ে যাবে আবার….
মল্লিকা ফিরে গেল। যাওয়ার আগে গোঁসাইয়ের হাতে দুটো আম দিয়ে গেল। বলল, খেয়ো।
গোঁসাই মাথায় ঠেকিয়ে বলল, আয় মা।
ভোর হল। গোঁসাই ফিরল আশ্রমে।
আশ্রমে দেড় বছর পর চিঠি এলো। মল্লিকার চিঠি। তার ভালোবাসার সে মানুষ মারা গেছে। কিন্তু সে মরতে মরতেও মরেনি। পারেনি। ভালোবাসায় আটকিয়েছে। একটা স্কুলে রান্নার কাজ পেয়েছে। গোঁসাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার বাড়ি।
গোঁসাই লিখল,
মা,
গোবিন্দের ইচ্ছা হলে আমাদের আবার দেখা হবে। তোমার চিঠি পড়ে বুঝলাম তুমি শান্তি পেয়েছ, আনন্দ পেয়েছ। তোমার ভাষায় তা স্পষ্ট। তোমার হাতের আঙুলের ছোঁয়ায় জন্মানো শব্দগুলোও সেই কথা বলছে। কোনোদিন বিষাদে ডুবে যেও না। বিষাদ থেকে দূরে থাকবে। নাম, প্রেম আর সত্যকে এক বলে জানবে। এককে ছেড়ে আরেক থাকতে পারে না। প্রমাণ, মা ডাক। ওই ডাকই প্রেম। আর ওই ডাক যে কত সত্য সে যে ডাকে সে-ই জানে। গোবিন্দই মা। গোবিন্দকে সত্য জেনে নিজে সত্য হও মা। মাঝে মাঝে কুশল সংবাদ জানিয়ে আমায় সুখী কোরো।
শ্রী হরি শরণম্