মানুষের চিন্তার একটা বড় ভ্রম হল সে বিশ্বাস করে ভিতরটা না বদলিয়ে বাইরেটা বদলাতে পারবে। তার সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি সব যে তার অন্তর্জগতের প্রতিফলন তা সে জানলেও স্বীকার করে না। কারণ তার একটা বদ্ধমূল ধারণা অন্তর্জগতের যা কিছু অ-সভ্য প্রবৃত্তি, সে সবকে সে বাইরের শাসনে আটকে রাখতে পারে, তাকে বেশ করে “ডিসিপ্লিন” শিখিয়ে কষে বেঁধে রাখতে পারে, তবেই সে সায়েস্তা হয়, সমাজ নির্বিঘ্নে চলে। সে কুপ্রবৃত্তির পরিবর্তনের কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না।
এই তাত্ত্বিক বিশ্বাসের জন্যেই বালির উপর আমাদের সমাজের প্রাসাদ। সব সময় ভয়, এই বুঝি আসল চেহারাটা সামনে চলে এলো। এই বুঝি শাসনের আগল ঠেলে সেই আদিম বর্বর দিকটা বাস্তবে চলে এলো। ভয় অমূলক নয়। এ-ই নিয়েই তো আমাদের সমাজ।
কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের পূর্বতন সমাজসংস্কারকেরা শিক্ষার উপর আস্থা রেখেছিলেন। শিক্ষা অর্থে তারা সেই বিশুদ্ধ জলের কথা ভেবেছিলেন, যা নিজে দূষিত না বলে অন্তরে গিয়ে অন্তঃকরণকে বিশুদ্ধ করে মানুষকে শুদ্ধ করে তুলবে। অন্তত আংশিক হলেও। কিন্তু কীভাবে?
যে শিক্ষার কথা তাঁরা ভেবেছিলেন, আর আজ শিক্ষা বলতে যা বুঝি ঠিক তার বিপরীত। আজ শিক্ষা একটা কমোডিটি, একটা ইনভেস্টমেন্ট। ফেল কড়ি মাখো তেল। সে শিক্ষায় কেরিয়ার তৈরি হয়, কিন্তু নিজেকে সংশোধনের ক্ষেত্র হয় সীমিত, নয় শূন্য। স্কুলের পাশাপাশি চলে টিউশান। সে জানে টিউশান কাকে বলে। ভারতের একটা শহুরে পরিবার ১২% আর গ্রামের পরিবার ১৫% পড়াশুনা বাবদ বরাদ্দ খরচের ব্যবহার করে শুধু টিউশানের জন্য। টিউশান অর্থে তোমাকে আরেকটা থার্ড পার্টি সফটওয়্যার জুড়ে দিলাম যাতে তোমার “পারফর্ম্যান্স” আরো ভালো হয়। টিউটর তোমাকে মনোরঞ্জনের সঙ্গে, মেরেধরে যে কোনো উপায়ে তোমার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেবে, কারণ সেটা তার ব্যবসা, নিজের স্বার্থেই সেটাকে তার টিকিয়ে রাখতে হবে। তারা ভালো পারফর্ম্যান্স দেখাতে পারলে তারা আরো ফুলেফেঁপে উঠবে। আজ তাই স্কুলের পাশাপাশি আরেকটা সমান্তরাল প্রাইভেট টিউশান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে নিজেদের অপরিহার্য প্রমাণ প্রায় করেই ফেলেছে। তাদের পুঁজি মানুষের স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার ভয় আর স্বপ্নকে বাড়িয়ে লোভকে ভর করে। (দুর্ভাগ্য হল এই লেখাটা যে লিখছে সে নিজেও সেই তন্ত্রেরই অংশ। এ সাফাই না। স্বীকারোক্তি। তার চেষ্টা এই কাজটাকে কী করে কেরিয়ার গড়া সর্বস্ব না করে পাশাপাশি আরো কিছু শেখানোর ব্যবস্থা রাখা, চর্চার ক্ষেত্র গড়ে তোলা যায় সেটা। সিম্পোজিয়ামের মত। কিন্তু সে আত্মকথনের জায়গা এটা না।)
যারা একটা নির্দিষ্ট সময় আয়ু পেয়েছেন, এবং আনবায়াসড, অবজেক্টিভ খোলা দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন, তারা জানেন সরকার বদলালে সমাজ বদলায় না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সরকার বদলের দরকার নেই। অবশ্যই আছে। তাতে সমাজের মেশিনারিগুলো কিছুটা অদলবদল হয়। আবার ধুলো জমতে থাকে। কারণ যারা সরকারের সেই বিরাট কর্মকাণ্ডের মেশিনারি চালায়, তারা বদলায় না।
তবে বদলায় কীসে? আঘাতে। সেন্টিমেন্টের আঘাতে না। চেতনায় আঘাতে। সেণ্টিমেন্টের আঘাত সাময়িক। তাতে আন্দোলন তৈরি হয় না। আলোড়ন তৈরি হয়। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিত হয়ে যায়। সেন্টিমেন্টকে জাগিয়ে রাখতে হয়, উস্কিয়ে রাখতে হয়। চেতনা একবার জেগে গেলে সত্যপ্রতিষ্ঠ না হওয়া অবধি থামে না।
আঘাত মানুষকে কী দেয়? সীমাবদ্ধতার জ্ঞান। যাকে বা যে সিস্টেমকে সে নির্ভুল, বিকল্পহীন ভাবছিল, তাকে প্রশ্ন করার সাহস জাগে। একদিন সমাজে মেয়েদের যে জায়গায় রাখার চেষ্টা হয়েছিল, সমাজকে নানা কুসংস্কারে বেঁধে জড়পিণ্ডে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছিল, তার থেকে বাঁচিয়েছে তাকে প্রশ্ন, সংশয়। প্রতিষ্ঠিত নানা ধর্মীয় মতের, নানা অমানবিক আচারকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস তাকে দিয়েছে আঘাত। ভয় তাকে দমাতে পারেনি। কারণ সে সত্যকে স্পষ্ট দেখেছে বলে না, মিথ্যাকে স্পষ্ট দেখেছে বলে। জেনেছে বলে। যে সত্যকে স্পষ্ট দেখাতে চায়, সে চিরকাল মানুষকে কোনো না কোনো তত্ত্বে বাঁধে, ডগমায় জড়ায়। কিন্তু যে মিথ্যাকে স্পষ্ট করে দেখায় সে মানুষের নিজের হাতে গড়া কারাগারকে স্পষ্ট করে দেখায়। সে বাইরেটা কী স্বচ্ছভাবে না জানলেও, মুক্তির আসল রূপকে অবজেক্টিভলি না জানলেও কারাগার যে মিথ্যা সেটাকে স্পষ্ট করে জানে, তাই দাপিয়ে ওঠে। গর্জন করে ওঠে।
একদল মানুষ সমাজের মূল চালিকাশক্তি করতে চাইছে ভোগকে। যে যত বেশি নিজের বাসনা চরিতার্থ করতে পারে সে যেন তত স্বাধীন। তত সফল। বাসনার, লোভের চরিতার্থতাই যেন মানুষের জীবনের চরম মাপকাঠি। এই বোধটাই কারাগার। যার পায়ে আমাদের শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান দাসখত লিখে দিয়ে বসে আছে। এর বাইরে আরেকটা কাজ যে তার অপেক্ষায় আছে, সে ভুলে আছে । মনুষ্যত্বের প্রাথমিক দায়িত্ব তার নিজের আর সমষ্টির মঙ্গলের প্রতি তার কর্তব্যবোধ। যা ঠিক, যা সত্য, যা ন্যায় তা যদি তার বাসনা-লোভের কাছে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তৎক্ষনাৎ তাকে ত্যাগ করা। এ শক্তি সে নিয়েই জন্মেছে। একে চিরকালের জন্য যে আটকানো যে যায় না বাংলার মানুষ তার সাক্ষী শেষ কয়েক মাসে।
তবে কী সে আন্দোলনে কিছুই হয়নি? হয়েছে। আজ আমাদের এখানে ভোট। যখন ভোটের বুথে ঢুকছি, তখন বারবার আমার চোখ ভিজে আসছে। আমি যখন ইভিএম মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার দৃষ্টি ঝাপসা আমারই চোখের জলে। একটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। লোভ যার চালিকাশক্তি। স্বার্থান্ধতা যার উকিল। তাকে বদলাতে গেলে এই যে স্কুলে দাঁড়িয়ে আছি, এই যে বিদ্যার্থীরা বছরে বছরে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট, ফ্রক থেকে শাড়ি হবে, তাদেরকে বদলাতে হবে। তাদের সামনে বারবার মনে করাতে হবে তাদের মানুষ হিসাবে কর্তব্যবোধের কথা। নিজেকে দূষণমুক্ত রাখতে পারার ইমিউনিটি গড়ে তোলার কথা। জীবন যে মামুলি স্বার্থসুখী হওয়ার চাইতে আরো বড় কারণে বাঁচা যেতে পারে সে সম্ভাবনার কথা। মনে রাখতে হবে একজন দূষিত শিক্ষক যতটা একজন শিশুকে নষ্ট করতে পারে, সে ক্ষমতা সমাজের হয় তো আর কারুরই নেই। তার বিপরীতটাও সত্য। সুশিক্ষা সু-সিলেবাসে হয় না, সুশিক্ষকের হাত ধরে আসে।
একজন দূষণমুক্ত মানুষের বোধ একটা সমাজের জন্য যে আলো জ্বালাতে পারে, তা কোনো বিজ্ঞান, কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পারে না। আর মানুষকে দূষণমুক্ত করে তার সংশয়। বিশ্বাস না। যা কিছু ধ্রুব বলে দেখানো হচ্ছে তাকে প্রশ্ন করার সাহস। নিজের লোভকে আর বাইরের দূষিত অথোরিটিকে অস্বীকার করার ব্রতে।