Skip to main content
 
এতদিন অসুস্থতা ও মৃত্যুর পরিচয় ছিল, তারা ব্যক্তিগত। নিজের ভয়, নিজের আতঙ্ক, নিজের শোক নিজেকে নিয়ে, নিজের করুণা নিজেকে নিয়ে - সবই ব্যক্তিগত পরিসরে। বড়জোর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে।
       আজ কতদিন হয়ে গেল, সব বদলে গেল। মৃত্যু এখন ব্যক্তিগত না। সমষ্টিগত। রোগের ভয়, আতঙ্ক ব্যক্তিগত নয়, তাও সমষ্টিগত।
       একজন মানুষ ছাদে উঠে পাশের বাড়ির সুপুরি গাছের ডাল কাটবে। গরীব মানুষ। ডাল কাটলে দুটো পয়সা আসবে বাড়িতে। মুখে মাস্ক নেই। একবার ভাবলাম বলি। কিন্তু বললাম না, বলতে পারলাম না। ছাদে উঠল। প্রচণ্ড গরম। দুপুর একটা। ছাদের থেকে জানলার শেডে নেমে গেল। সুপুরি গাছে দড়ি বাঁধা। যেভাবে উঠছে নামছে গাছ বেয়ে, মুখে মাস্ক লাগিয়ে তা সম্ভব? না। যেভাবে শ্বাস নিচ্ছে, তাতে মুখে মাস্ক লাগিয়ে কাজ করা সম্ভব না। অসুস্থ হয়ে পড়বে।
       মানুষটাকে আমি চিনি। তাই হয় তো আতঙ্কিত হলাম না। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথাতে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল, যারা রিকশা টানবেন, বা এই ধরণের কায়িক শ্রম করবেন যেখানে শ্বাসের হার সাধারণ অবস্থা থেকে বেশ কয়েক গুণ বেশি। সে কি সম্ভব? মাঝারি স্পিডে সাইকেল চালালেই যেখানে হাঁপ ধরে যাচ্ছে সেখানে এই ধরণের শ্রমে মুখে মাস্ক পরে কিভাবে হবে?
       তবু হতেই হবে। হওয়াতেই হবে। নইলে সে কাজ পাবে না। একজন অপরিচিত মানুষ, মানে যার যাতায়াত গতিবিধির সীমানা আমার অজানা তাকে আমি এমন নির্ভয়ে বিনা মাস্ক কাজে লাগতে বলতে পারব? হয় তো পারব না। হয় তো সে যখন কাজ করবে তখন জলের বোতল চাইলে দূর থেকে ছুঁড়ে দেব। বা হাতের কাছে দিয়ে আসব নিজে মাস্ক পরে, ঘরে ঢুকেই কুড়ি সেকেণ্ডের জায়গায় কুড়ি মিনিট ধরে হাত ধুয়ে।
       অবশ্যই এসব করতে হবে। মৃত্যু আজ বড় সার্বজনীন জেনেও করতে হবে। অসুস্থতা আজ ভীষণ সার্বজনীন জেনেও নিজেকে আপ্রাণ ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে।
       ভয় শুধু একটা জায়গাতেই। আমরা যেমন চিকিৎসার সাথে যুক্ত মানুষকে ঘর থেকে বার করে দিতে পারি নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে, আবার এর বিপরীতে আমরা তেমন ফুলচন্দন, শাঁখ উলুধ্বনি দিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে রোগজয়ীকে বরণও করতে পারি। দুটোই অতিসক্রিয় স্পর্শকাতর দুর্বল মানসিকতার লক্ষণ। যেমন আমরা বুঝে উঠে পারলাম না আজও যে চিকিৎসক দেবদূতও নন আবার যমদূতও নন। বিজ্ঞানের অনুগামী তিনি।
       কিন্তু আমাদের যথার্থ বিজ্ঞানের চাইতে আবেগীয় জ্ঞানের তাড়না বেশি। তাতে বন্ধুতা আর শত্রুতা দুইই বড় অস্বাভাবিক পরিমাণে মেলে। চঞ্চল আবেগের তাড়ানায় বিজ্ঞানের বিধান সেই মানটুকু পায় না, যা আমাদের অমূলক ভয়, আতঙ্কর গুঁতোয় মনগড়া তত্ত্বরা পায়।
       সামনের দিনগুলোতে ভয় এটাই। রোগ তার নিয়মের বাইরে যাবে না। কিন্তু যে জাত মারীগুটিকায় আক্রান্ত বাসবদত্তাকে পরিখার বাইরে রেখে আসে, সে কি সব সময় সে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে পাবে? হয় তো না। সমাজে সেদিন কোন ব্যাধির প্রকোপ বেশি হবে? আজই পড়লাম কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নাকি যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে রুগীর যাতনা আর অবহেলার শেষ নেই। কোনো সাফাইওয়ালা ইত্যাদির যাচ্ছেন না, মৃতদেহ বাইরে আনতেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকছে আত্মীয়ের অপেক্ষায়।
       এরপর তো এ সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করবে। খাজনার চাইতে বাজনা বেশি হবে। মানুষের থেকেই দূরত্ব বাঁচিয়ে জীবিকা নির্বাহ সব মানুষের পক্ষে কতদিন সম্ভব হবে? জানি না। যেখানে সমাজের মূলসূত্রই ছিল একসাথে থাকা, জোট বেঁধে থাকা। তাই শুধু সামাজিক দূরত্ব বাড়ানোতেই থেমে গেলে হবে না, বিজ্ঞানকে সাথী করে সামাজিক নৈকট্যের দ্বারও খুলতে হবে অন্য উপায়ে। মানুষের মন তো আর মনরোগ চিকিৎসকের ভরসায় শুধু বাঁচে না, বাঁচে সহমর্মিতায়। সেটুকু যেন কেউ না কেড়ে নেয়। মৃতুও না। কারণ মৃত্যুর চাইতে তার ভয়টি আরো বড়। আরো বেশি অমানবিক।