স্টেশানে সি অফ করতে গিয়ে লোকটা বুঝল, আসলে সে তাকে বোঝেইনি কোনোদিন। অচেনা লোককে কেউ সি অফ করে?
ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর এক প্যাকেট চিপ্স আর একটা কোলড্রিংক্সের বোতল নিয়ে ফাঁকা প্লাটফর্মে বসে পড়ল। পরের ট্রেন আসার আগে তো নতুন কোনো যাত্রী নেই।
রাত হল, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে কই? যেন বাড়ি বলে ছিলই না কিছু কোনোদিন। যে ছেড়ে গেল, সেকি আদৌ এতগুলো বছর ছিল পাশাপাশি? নিজের ভিতর থেকে নিজেকে বারবার নতুন নতুন রূপে জন্ম দিতে শিখে গেল কবে? কেউ কি নিজেকে সত্যিকারেই বাইরে ভিতরে পায়? কোথাও কি থাকে না কিছু গোঁজামিল। কিছু মিথ্যা। কিছু অপলাপ। এত সত্য সহ্য করবে যদি তবে মানুষ মানুষ হল কেন? মানুষ গাছ, পাথর, আগুন, মাটি হতে পারত।
নিজেকে নিজে আর সৃষ্টি করবে না। নিজেকে বন্ধ করে দেবে নতুন নতুন নিজের মত হওয়া। এত এতগুলো নিজের মধ্যে দিশা পাওয়া ভার এখন। কে যায়?
আমি স্টেশান মাষ্টার। আপনি?
আপনি মিথ্যুক। আপনি সত্যিকারের কি আপনি নিজেও জানেন না। মানুষ কেমন জানেন? একটা নানা মশলায় বানানো পাহাড়। বাস্তব যেমন যেমন আঘাত করে তেমন তেমন টুকরো খুলে আসে। রঙ-বেরঙের টুকরো। আপনি নিজেও জানেন না পরের টুকরোটা কি বেরোবে। আপনি বারবার ভেবে যান এই বার এরকম আঘাত এলে আমি এমন রঙের পাথর হব। হয় না... হয়? হয়? হয়?
চলে গেলেন? আরে ও দাদা... আপনি শুধু না, আমিও মিথ্যুক.. এতে লজ্জার কিছু নেই…. মানুষের জীবনে একটাই সত্যি... নিজেকে মিথ্যুক বলে জানা... নিজেকে ছল বলে জানা…. শান্তি পাবেন… ও দাদা…
এই তো ফিরে এলেন….
আপনি কি আত্মহত্যা করবেন ভাবছেন? প্লিজ আজ করবেন না... আমার ছেলেটার জন্মদিন আজ.. আমি এই ডিউটিটা সেরেই বাড়ি ফিরব... প্লিজ আজ না... অন্যদিন করুন... আমি ট্রেনের টাইম বলে দেব... আজ নয় প্লিজ…..
না না... এটা ভাবিনি। আমি কেন আত্মহত্যা করব? আমি তো ধূর্ত। আমি কোনো কিছুই গভীরে হই না। না হতাশ, না উচ্ছ্বাস। আমি আমিই। ঘটমান বর্তমান। আমি আছি। আমি থাকব। আমি হয়েছি। আমি হব।
আপনি মাতাল।
না, পাগল বলতে পারেন। কেন জানেন? আমি জানি আমি সুস্থ নই। যার মন আছে সে সুস্থ হয় কি করে দাদা? যার মন আছে সে-ই পাগল। আপনার মন নেই। অভ্যাস আছে। আপনি আত্মহত্যা করতে পারেন। অভ্যাস ভাঙলে মানুষ আত্মহত্যা করার কথা ভাবে। মন ভাঙে না। মন ধূর্ত। নিজেকে বদলে বদলে নেয়। তাই টিকে যায়। আমি যেমন টিকে আছি।
আপনার কোনো নীতি নেই..
না নেই। আমার শ্রেষ্ঠ নীতি আছে। পরিবর্তন। আমি সব পরিবর্তন মেনে নিই। কেন জানেন? কারণ আমি আমাকে চিনি না। আপনি ভাবেন আপনি নিজেকে জানেন, তাই নীতি দিয়ে বাঁধেন। আমি জানি আমি জানি না…
উঠে গেলেন আবার... আচ্ছা যান... মড়া মানুষের সঙ্গ আমার ভালোও লাগে না... শালা জিজ্ঞাসা করতে এসেছে আমি মরব কিনা….
ট্রেন এলো। নতুন যাত্রীরা উঠবে। এটাই প্রথম স্টেশান। আমি আজ সারারাত ঘুরব। একা একা। নিজেকে অস্থির করব নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে স্থির। তারপর কি হবে কেউ বলতে পারে না। কেউ না। কারণ কেউ নিজের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না খোলা চোখে। একটা গল্পের আবরণ লাগে। সে গল্প ঈশ্বর কি রাজনীতি ফারাক পড়ে না…. আজ আমি নিজেকে পাগল করে দেব নিজের দিকে তাকিয়ে.. যতক্ষণ না আমি আমার সত্যিকারের বাড়ির খোঁজ পাই।
লোকটা বাড়ি এলো। অনেক অতিথি। আজ তার ছেলের জন্মদিন। যে চলে গেল, যাকে ছেড়ে এলো স্টেশানে সে হয় তো এই মুহূর্তে একা একা বসে আছে কোনো বেঞ্চিতে, অন্য কোনো অজানা স্টেশানে একা। সেও সে। এও সে। আসলে কোনোটাই সে নয়। কিম্বা আসলে নিজে বলেই কিছু নেই। একটা সময়ের পাঁচিলে গড়ে ওঠা নানা ঘটনার অধঃক্ষেপ - ছায়া। ছেলে ডাকছে। কেক কাটা হবে। আজ জন্মদিন। শরীরের জন্মদিন। মানুষের মনের কত লক্ষ জন্মদিন আর মৃত্যুদিন হয়?