Skip to main content

 

মানুষের এক বিড়ম্বনা হল সে নিজেকে দিয়ে বিশ্বসংসারের নাড়ীনক্ষত্র জেনে ফেলতে চাইছে, জানছেও, কিন্তু সে নিজেই নিজের কাছে থেকে যাচ্ছে অধরা।

কেউ বলল, ওহে, তুমি নিজেকে জানবে কী? তুমি যে “আমি” বলে একটা কিছু ভাবছ, অমন তো কিছুই নেই। রাস্তায় যেতে যেতে কুয়াশার উপর গাড়ির ছায়া দেখেছ না? কিম্বা মেঘের উপর এরোপ্লেনের ছায়া? তুমি অমন ধোঁয়া, কুয়াশা, মেঘ। তার উপর এই বিশ্বসংসারের আবছায়া ছায়ারা। জানবে কী ভাই?

কেউ বলল, দেখো, বাইরে থেকে যা কিছু সংগৃহীত অভিজ্ঞতা, কেউ তোমার মনের মধ্যে নিজের মাধুরী মিশিয়ে জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করছে। কিন্তু সে যে কে, তাকে জানবে কী করে? উপায় নেই যে। সব কিছু জানাকে সে নিজের থেকে সুতোর মালায় গেঁথে তোমায় দিচ্ছে বটে, কিন্তু জানতে চাও তুমি কে? ব্যস। সে বোবা। সে কালা।

তবে? যা দিয়ে সব জানছে তাকে জানার উপায় নেই?

দার্শনিক বলল, নেই। কবি বলল, ওদের কথা ছাড়ো তো। আছে। এখন বলো, তুমি নিজেকে “নেই” এর মধ্যে দেখবে, নাকি “আছে” র মধ্যে দেখবে?

সে বলল, দুই-ই বলো। কবি বলল, ধরো একটা সমুদ্র। তাতে ঢেউ উঠছে, পড়ছে। তুমি তেমন ধারা। এই উঠলে, এই পড়লে। এভাবে দেখলে তুমি কষ্ট পাবে, অথবা অসংবেদনশীল উদাসীন হবে। থাক। তার চাইতে গোটা সমুদ্রকে দেখো। ঢেউ যদি সমুদ্রের আয়নায় নিজেকে দেখে, তবে তার ভাঙা গড়া তার কাছে চরম মনে হয় না। কিন্তু যদি নিজেকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখে তবে সমুদ্রের উপর তার অভিমান হয়। বলে সব শূন্য।

দার্শনিক বলল, যত্তসব বাজে কথা। সমুদ্রের সঙ্গে ঢেউয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। সে একটা ঘটনামাত্র। কবি বলল, তুমি যাকে শুধু ঘটনা বলো, আমি তাকে আনন্দের ফোয়ারা বলি। যার তোড়ে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়।

দার্শনিক আর কবি চুপ করল। চলে গেল। সে এটা বুঝল সে নিজেকে নিজের মধ্যে জানতে পারবে না। আয়না চাই। সম্পর্কের আয়না। কেউ বলল, তুমি জগত পিতার সন্তান। কেউ বলল, তুমি জগত মাতার সন্তান। কেউ বলল, তুমি শ্রীগোবিন্দ রাধার আজীবনের সেবক। সবাই হাতে তুলে দিচ্ছে সম্পর্কের সুতো। মন কী চায়?

গুরু এসে জিজ্ঞাসা করল।

শিষ্য বলল, মন কী চায় সে-ই তো এতদিনেও জানলাম না।

গুরু হাসল। বলল, মন যদি জানতে পারত সে নিজে কী চায়, তবে সে মন হবে কেন? মনের কাজই তো দোলাচালে দুলুনিতে রাখা। সে দুলুনি ভালো লাগে বলেই তো সংসার ভালো লাগে। দেখো না দুলুনি থামলেই মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে।

শিষ্য বলল, তবে?

গুরু বলল, হাঁটো, হাঁটো। হাঁটা থামিও না। রাস্তা যত দীর্ঘ হবে পরিচয় তত নিবিড় হবে। একদিন জানবে। প্রান্তে পৌঁছাবে। সেদিন যখন তোমায় এসে কেউ জিজ্ঞাসা করবে, উপায়? তুমিও বলবে, হাঁটো, হাঁটো। যা চলে পাওয়ার জিনিস, তাকে বসে পাওয়া যায় না।