গতকালের কথা। দুপুর গড়িয়ে সদ্য বিকাল হয়েছে। এক বিশেষ দলের বেশ কিছু রাজনীতির মানুষ বাড়ি বাড়ি স্লিপ দিচ্ছেন। অবশ্যম্ভাবীভাবেই কারোর মুখে মাস্ক নেই। কারণ, "আমাদের এদিকে তেমন আসেনি"..."পকেটে আছে, এই খুললাম"..."গরম লাগে"...ইত্যাদি নানা ভ্যালিড কারণ তো আছেই। তাছাড়া কপালে থাকলে কে আটকাবে - এর থেকে বড় জীবন দর্শনই বা কি থাকতে পারে!
একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম, লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছেন। খুবই মন্থর গতি। একটু দাঁড়াচ্ছেন, শ্বাস নিচ্ছেন, আবার হাঁটছেন। আমার চোখে কয়েকবার চোখ পড়ল। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, কি বলব, বিনা মাস্ক এভাবে বেরোনো!
আমার পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছেন আমি থাকতে না পেরে বললাম, আপনি মাস্ক পরেননি কেন?
উনি দাঁড়ালেন। সলজ্জ হেসে বললেন, আমি জানি তুমি আমায় খেয়াল করছ। আসলে আমি বাড়িতে ফেলে এসেছি। আমার মাস্ক আছে। আমি সামনে এই একটু দোকানে যাচ্ছি।
আমার এক বন্ধু বলল, আমার কাছে অতিরিক্ত মাস্ক আছে, নেবেন?
ওনার মুখে আবার সেই সলজ্জ হাসি। ওনার হাতে মাস্কটা দিলাম। সার্জিকাল মাস্ক। উনি এক হাতে লাঠিটায় ভর দিয়ে আরেক হাতে মাস্ক পরার চেষ্টা করলেন। তাই কি হয়?
আমি বললাম, দিই পরিয়ে?
সম্মতি জানালেন। একটা কানে লাগিয়েই ছিলেন, আরেকটা কান অবধি মাস্কের বন্ধনী নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলাম, কানে হাত লাগবে, কিছু মনে করবেন না তো?
উনি বললেন, তুমি তো বাবা আমার ছেলের মত, দাও পরিয়ে!
পরিয়ে দিলাম। উনি আবার মন্থর গতিতে এগিয়ে গেলেন।
বিকালের রোদ জলহীন পুকুরের উপর পড়ে। বহু মানুষ মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুকুরগুলো পুকুরের কাটা মাটিতে গড়াগড়ি করছে। আসলে আমাদের বিবেচনা নেই। আমাদের প্রবৃত্তি আছে। আমাদের সুখের প্রতি অন্বেষণ আছে। ভয়ের প্রতি বিরাগ। বিবেচনা বা ভয় দুটোই যখন কাজ করে না, তখন সেটা অবশ্যই চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। কিন্তু যারা মনে করছেন প্যানিক সৃষ্টি করে কাজ করিয়ে নেবেন, সে হয় না। বেশি প্যানিকড হলে মানুষ আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে যায়। অজ্ঞতার বেপরোয়াভাব আর প্যানিকের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে বেপরোয়াভাবের মধ্যে পার্থক্য আছে। শেষেরটা ভীষণ তীব্র।
আমাদের কিছু অভ্যাস ছাড়তে হবে। যেমন সারাদিন নঞর্থকভাবের চাষ....
১) ভ্যাক্সিন নিয়ে লাভ নেই। আবার হবে।
২) ভ্যাক্সিন নিরাপদ নয়।
৩) সরকার কিচ্ছু করছে না।
৪) হাস্পাতালে আসলে গেলে কিছু হয় না। ওখানে চিকিৎসা নেই।
৫) এবারে যা হচ্ছে, হলে আর বাঁচার আশা নেই।
৬) যা হবার হবে। মাস্ক পরেই বা কি।
এইগুলো অপরাধ। গুরুতর অপরাধ। একটা নেগেটিভ চিন্তা করোনা ভাইরাসের মতই ক্ষতিকর। তাকে স্প্রেড করা আরো আরো ক্ষতিকর। মাস্ক পরে করোনা আটকানো যায় অনেকটাই, কিন্তু নিজের নেগেটিভ চিন্তার বিষ ছড়াবেন না দয়া করে। কোনো দরকার নেই আমাকে আপনাকে ক্রিকেটের স্কোরের মত মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যার হিসাব রাখার। বরং পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি। পজিটিভিটি স্প্রেড করুন। ক্ষয়ক্ষতি নেই বলছি না, কিন্তু তাকে নিয়ে ভাষায় আর ভাবে উদযাপনে কোনো লাভ নেই আসলেই।
ভালো থাকুন। এগিয়ে আসুন। মাস্ক দিন। স্যানিটাইজার দিন। অনলাইনে পড়ার জন্য মোবাইল রিচার্জ করে দিন যার দরকার। পুরোনো মোবাইল থাকলে দিন। আর যদি এগুলো কিছুই না দিতে পারেন, তবে কেউ নেগেটিভ কথার বিলাসিতা করলে থামান। পরিবেশ শুদ্ধ রাখুন। দরকার হলে অসভ্যের মত থামান।
বাবা ভ্যাক্সিন নিয়ে বসে আছেন। এক ঘর মানুষ অপেক্ষা করছেন বিধি অনুযায়ী আধঘন্টা। এমন সময় এক মাঝবয়েসী মহিলা চেয়ারে বসে ওনার কোন কোন আত্মীয় ভ্যাক্সিন নিয়ে অসুস্থ সে নিয়ে আলোচনা ফেঁদে বসেছেন। আমি গিয়ে বললাম, এইসব আলোচনা না করলেই কি নয়? আপনার কি মনে হয় এতে এখানে যারা বসে আছেন কারোর কিছু লাভ হবে?
উনি থামলেন। রাগলেন। তারপর অরিজিৎ সিং এর কান্নাভেজা গান জোরে চালিয়ে পা চেয়ারে তুলে বসলেন। আমি বেশ জোর গলায় বললাম, ভালোই হবে তো, না হয় একদিন জ্বর হবে, বাড়ির লোকের অ্যাটেনশান পাওয়া যাবে। এই যেমন আমার বাবার, কদ্দিন জ্বর হয়নি... তাই না?
ঘরে হাসির হিড়িক উঠল। একজন মহিলা বললেন, ধুর কে দেখবে, আমাকেই রাঁধতে হবে... পাশের মহিলা বললেন, আর না তো কি....
ব্যস, আলোচনা ঘুরে গেল। অন্তত সেই আতঙ্কের গুমোট পরিবেশটা কেটে গেল।
মানুষ নিরেট বাস্তবে কতটুকু বাঁচে? মানুষ বাঁচে মনে। নিরেট বাস্তবে বাঁচে পশু। তাই মন দমে গেল তো সব হারিয়ে গেল। ওটুকু যেন হারিয়ে না যায় সেটুকু খেয়াল রাখবেন প্লিজ। আর কিই বা করতে পারি।