Skip to main content
সারাটা দিন হাসপাতালে কাটল আজ। বহুদিন পর। মনটা খানিক উদ্বিগ্ন কারণ অপারেশনটা গুরুতর, খানিক বিকল কারণ মা শেষের দিকে কয়েকদিন ছিলেন এখানে, অবশ্য একদম অন্তিম মুহূর্ত অবধি নয়, সেটা আমাদের ওখানকার হাসপাতালে।
        ঢুকতেই দেখলাম কিছু মানুষ ফুলের সজ্জা নিয়ে অপেক্ষারত, পাশে বিশেষ গাড়ি দাঁড়িয়ে একটা। বুঝলাম যার জন্য অপেক্ষা তিনি আসবেন না, তাকে নিয়ে আসা হবে। উদাস চোখের দৃষ্টি। মুঠো ভরতি সঞ্চয় অসীমে হারিয়ে গেল, কে খুঁজবে? কাকে দুষবে? সম্বল তো কান্না আর কান্না। কে শুনবে?
        অপারেশন শুরু হল। বলা হয়েছে ঘন্টা তিনেক লাগবে। হাঁটছি ওটির সামনে। বসার জায়গায় বসে কিছু মানুষ। এটা ওটি কমপ্লেক্স, অনেক অপারেশন একসাথে চলছে। অনেক আত্মীয়। ব্যস্ততা নেই, তীব্র অপেক্ষা। প্রতিটা মুহূর্ত যুগের মত অসহ্য ধীর। ওদিকে কে কাঁদছে, আঁচলে মুখটা চেপে। কম বয়েসী মহিলা একজন। চোখের জল বাঁধ মানছে না। হেঁটে কাছে যেতেই চিনতে পারলাম, আরে এ তো আইসিইউ। চিনি তো। ওই তো বেডটা। মা ছিলেন। 
        মনটা সময়ের পিছনে হেঁটে রক্তাক্ত হল যন্ত্রণায়। তবে শুধুই যন্ত্রণা। সব খারাপ ব্যবহার, অসহায়তা দেখলাম খুব একটা টাটাচ্ছে না। আশঙ্কা করেছিলাম। অবশেষে তো সব কিছুই একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের কথা। একটা মানুষের চোখে আরেকটা মানুষের চোখ। একটা মানুষের উপর আরেকটা মানুষের নির্ভরশীলতা।
        শব্দটায় ঠেক খেলাম, নির্ভরশীলতা। বিশ্বাস। ওটিতে বিরাট বড় বুদ্ধের দেওয়াল চিত্র। নির্ভরতা। হাসপাতালে সব রুগীর আত্মীয়। যন্ত্রণার উপশম খুঁজতে আসা। কখনও অঙ্গ নিজেই অসহ্য যন্ত্রণার কারণ, কখনও জীবাণুর সংক্রমণ। অসহ্য যন্ত্রণা। দুঃখ আছে - প্রথম আর্যসত্য। যখন মাকে নিয়ে লড়ছি তখন এটাই আমার মুলমন্ত্র ছিল। আজও আছে। 
        ভেলোরের সিএমসি -র কথা মনে পড়ল। মাঝখানে একটা চার্চ, তাকে ঘিরে প্রকাণ্ড জায়গা জুড়ে হাসপাতাল। কাতারে কাতারে মানুষ ঢুকছে প্রতিক্ষণে। সারা ভারত থেকে, প্রতিবেশী দেশ থেকে। ভাষা বুঝি না সবার। অপেক্ষারত ঘরে সবাই সবার মুখের অভিব্যক্তি পড়তে পারি। একদিনের ঘটনা মনে পড়ল, মা ভীষণ অসুস্থ, হোটেলের ঘরে আছেন, পরেরদিন আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আমি ত্রস্ত হয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছালাম এমার্জেন্সির দিকে, একজন স্থূলকায়া মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? বললাম। শুনে স্মিত হেসে বললেন, আমরা তো সেই জন্যেই আছি, যখনই তোমার মনে হবে একটা গাড়ি করে নিয়ে চলে এসো, যত রাত হোক... আমরা আছি তো... ভয় পেও না। 
        মনে হল এই ভিন জায়গায় আত্মীয় পেলাম। মুহূর্তে আপন হয়ে গেল পুরো হাসপাতাল, আর ওই ভাষা না বোঝা মানুষগুলো। দু'দিন পর চার্চে বসে আছি। বেশ কয়েকটা টেস্ট করতে হবে। দেখলাম হাসপাতালে ঢুকলেন বিধান পুরস্কার পাওয়া ডাক্তার জর্জ চ্যাণ্ডি। হাঁটু গেড়ে বসলেন। প্রার্থনা করলেন। ফেরার সময় চিনতে পেরে পিঠে হাত দু'বার চাপড় মেরে বললেন, “দুশ্চিন্তা কোরো না, প্রার্থনা করো।” চলে গেলেন। বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা জায়গায় বহু মানুষ মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন। এটা তো চার্চ নয়, এখানে কেন তবে? জিজ্ঞাসা করলাম, বললেন, যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন এখানে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। কি আশ্চর্য! এরা কারা? মুখে চোখে কোনো অভিযোগ নেই কেন? এত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে এমন নির্ভরতা, আস্থা জন্মালো কি ভাবে?
        হাঁটতে শুরু করলাম আবার। তখন ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতাল আমার কাছে ওয়েসিস। ভয়ের না। "এ রুগী পেটে জল হয়ে হয়ে মরে যাবে"... কেউ বলল না... "এ তো লস্ট কেস, তৈরি থাকুন"... বলছে না কেউ তো... কেন ইংরাজীতে ওই শব্দগুলো নেই নাকি? যদিও আমিও জানি ওনারাও জানেন কিসের জন্য তৈরি থাকতে হবে... ডাক্তার বলেছিলেন... "আমাদের পরিস্থিতিটা ম্যানেজ করতে হবে, আপনাকেও আমাকেও। আপনি করবেন খেয়াল রেখে, আমরা করব ওষুধে, অপারেশানে। শেষে সব ওনার ইচ্ছা”। ওই যে যিনি আমার ভগবান ওনার গড।
        কোনো অভিযোগ নেই আজ আমার। সব কিছুই বিধাতার ইচ্ছা, মেনে নিতে শিখেছি। আমার জীবনটা তো আর এবিপি আনন্দের সান্ধ্য তর্জামঞ্চ নয়। আর সব কিছুর শেষে তো ভাগ্য-পরিস্থিতি-অনুকূলতা-প্রতিকূলতা তো আছেই। ও নিয়ে আর ভাবি না। যা থাকে কপালে। নিশ্চই আমাদেরও সেদিন আসবে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতির আনুকূল্যে যেদিন দক্ষিণভারতে মানুষ শুধু বেড়াতেই যাবেন। ট্রেন ভরতি অত রুগী দেখতে হবে না। অত কষ্ট করে একটা ভিনরাজ্যে শরণার্থীর মত পড়ে থাকতে হবে না। প্রচুর আলোচনা হচ্ছে চারদিকে। সেই আলোচনাতেই সব ধোঁয়াশা, ভুল বোঝাবুঝি কেটে যাবে, পারস্পরিক নির্ভরতা তৈরি হবে এমনই আশা করি। 
এতকিছু মাথার মধ্যে ঘুরছে। ওদিকে অপারেশন চলছে। মায়ের জন্য সে শোকটা বদলে গেছে। সে গল্পটা মনে আসছে, বুদ্ধ একমুঠো সরষে আনতে বলেছিলেন। কার কাছে সে সরষে চাইব? সে পুত্রহারা মহিলা সারা গ্রাম ঘুরে কোথাও একমুঠো সরষে পাননি। অথচ এমন কি আর কঠিন শর্ত বুদ্ধ দিয়েছিলেন, সে বাড়ি থেকে সরষে আনো, যে বাড়িতে মৃত্যু প্রবেশ করেনি। উনি পাননি সেদিন। আমি এত যুগ পরেও পেলাম না। 
অপারেশান শেষ হল। দুপুর। প্রচণ্ড রোদ। ফিরছি। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। আমার সামনে একজন কুলী। মাথায় বোঝা। ওর তো অভ্যাস আছে...ঠিকই তো অভ্যাসে কি না হয়... কারোর না খেয়ে থাকা অভ্যাস আছে...কারোর স্টেশানে শুয়ে থাকা অভ্যাস আছে.....আরো কত কত অমানবিক অভ্যাস আছে মানুষের...আর আমাদের দেখারও তো অভ্যাস আছে। অভ্যাসে কি হওয়া যায় - মানবিক না অমানবিক?