ছোটো হোটেল। বেঞ্চে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ আটটা রুটি, পাঁঠার মাংস আর তড়কা নিয়ে বসেছে। গোগ্রাসে খাচ্ছে। সারাটা মুখ ঘামে ভর্তি। জামা ভিজে চাপ চাপ। পাখা ঘুরছে মাথার উপর ফুল স্পিডে। সামনে টিভিতে ক্রিকেট চলছে। লোকটা মাঝে মাঝে চীৎকার করে উঠছে, মার মার শালা…. আউট… আউট…. যাহ্! *****
একটা মাছি নাকে, মুখে, কানে মাঝে মাঝেই বসছে। রুটি, মাংস, তড়কা, জলের গ্লাসের উপরও বসছে। দুটো ঘেয়ো কুকুর হোটেলের দরজার কাছে বসে। লোভী চোখ।
টিভি দেখতে দেখতে হঠাৎ লোকটার দুটো চোখ উপরের দিকে উলটে যেতে শুরু করল। মুহূর্তে মাথাটা রুটির থালায় এসে পড়ল। কপাল কেটে রক্ত রুটির উপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে শুরু করল। দেখতে দেখতে আরো চারটে মাছি কানে, নাকে, তড়কায় মাংসতে এসে বসল। কুকুর দুটো ধীরে ধীরে হোটেলের ভিতরে এসে ঢুকল। টিভিতে এখন অ্যাড চলছে। দাঁতের মাজনের। লোকটার মাংস লাগা দাঁতের উপর বসেছে মাছি একটা। ফ্যানটা ফুল স্পিডে চলছে।
হোটেলে এই দুপুরে লোক কেউ নেই। রাস্তাও ফাঁকা। আজ প্রায় ৪২ডিগ্রি তাপমাত্রা। আবহাওয়া দপ্তর থেকে বলেছে আজ তাপপ্রবাহ চলবে। তবে বিকেলের দিকে কালবৈশাখী হওয়ার সম্ভাবনা।
শান্তিপুর লোকাল হোটেলের দেওয়াল কাঁপিয়ে হুড়মুড় করে চলে গেল। দেওয়ালের আয়না, মা তারা, লোকনাথ বাবা অল্প অল্প নড়ে উঠল। বোধায় বেসিনের কলটা লিক। টপ্ টপ্ করে জল পড়ছে। হোটেল ফাঁকা থাকলে একটা চড়াই আসে জল খেতে। সে জানলায় বসে অনেকক্ষণ লোকটার দিকে তাকালো। মাথার চুল আর জামার কলার ছাড়া কিছু নড়ছে না। চড়াইটা কলের মুখে ঠোঁট লাগিয়ে জল খেল। জল খেতে খেতে কয়েকবার তাকালো লোকটার দিকে। হঠাৎ টিভিতে জোরে চীৎকার হল... আউট!!
চড়াইটা চমকে উড়ে গেল।
=======
দুপুরের শেষের দিকে আকাশ কালো করে মেঘ এলো। ঘন কালো। হোটেলের বাইরে থেকে হোটেলের ভিতরটা অন্ধকার। আসন্ন ঝড়ের আভাস পেয়ে ইলেক্ট্রিক অফিস থেকে কারেন্ট অফ্ করে দিয়েছে। পাখা বন্ধ। টিভি বন্ধ। বন্ধ টিভির স্ক্রিনে বাইরের রাস্তার প্রতিফলন। হোটেলের পিছন দিকে বড় একটা পুকুর। নোংরা পুকুর। এই পুকুরেই থালাবাসন মাজা হয়। লোকে কুলকুচো করে এখানেই ফেলে। হিসিও করে এদিকেই। সেই পুকুরের জলে ঝড়ের বাতাস লাগল। পুকুর অস্থির। পাশের গাছপালা দেখতে দেখতে ঝড়ের কবলে পড়ল। ঝড় উঠল ভীষণ ধুলো উড়িয়ে।
একটা পাগল রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে, দাঁড়া… আর এট্টু…. দাঁড়া….
বলতে বলতে পাগল হোটেলে ঢুকে পড়ল। অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে সামনে রাখা জলের ড্রামে ধাক্কা লেগে মেঝেতে পড়ল মুখ থুবড়িয়ে। তার উপর পড়ল জলের ড্রাম। আপাদমস্তক ভিজে পাগল উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়েই টেবিলে শোয়া মানুষটার দিকে তাকালো। তারপর ধীরে ধীরে নাকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে খাবারটা শুঁকলো। ততক্ষণে অগুনতি মাছি এসে গেছে। কুকুর দুটো রান্নাঘরে ঘুমিয়ে। পাগল লোকটার মাথাটা সরিয়ে থালা থেকে টেবিলে রাখল। তারপর বাকি রুটি মাংস আর তড়কা দিয়ে খেতে খেতে বলল, খাসনি কেন? পেট খারাপ! ভালো করেছিস… এই অবেলায় এসব কেউ খায়?
যখন ঝড় থামল, সবাই জানল, তখন পাগল ঘুমিয়ে রান্নাঘরে কুকুরগুলোর সঙ্গে। লোকটা চলন্ত টিভির দিকে মেলা চোখে শুয়ে। শ্যাম্পুর অ্যাড হচ্ছে। লোকটার মাথার অল্প কিছু চুলে মাংসের ঝোল লেগে। পাগলের হাতের আঙুলেও লেগে দু-একটা চুল। লোকটার মাথায় এই প্রথম বহুবছর পরে কেউ হাত রেখেছিল। মা মারা যাওয়ার আঠারো বছর পরে।