Skip to main content

শীতের দুপুর। আমি, আমার পাশে বসে আমার বন্ধুর বাবা, তার পাশে আমার বন্ধু। গাড়ি যাচ্ছে হালিসহর থেকে বারাসাত। বন্ধুর বাবার ক্যান্সার। শেষের দিকে। চিকিৎসার জন্য বারাসাতের একটা নার্সিংহোমে যাচ্ছি। আসলে সবাই জানি আর কিছু করার নেই, তবু চেষ্টা একটা করে দেখতে ক্ষতি কি?

দুপাশে ক্ষেত। গাড়িতে আমরা তিনজন মানুষ। কোনো কথা বলছি না। অথচ আমরা প্রত্যেকে জানি আমরা কি ভাবছি। ভাবনাগুলো বারবার একটা অন্ধকারের সামনে গিয়ে ফিরে আসছে। কান্না পাচ্ছে। অসহায় লাগছে। আমি চোখটা নামিয়ে দেখলাম আমার পাশেই কাকুর শীর্ণ শিরা বেরোনো হাতটা লাল কালো দাগ দাগ গাড়ির সিটের উপর রাখা। গাড়ির কাঁপুনিতে হাতটা কাঁপছে। আলগাভাবে মুখের দিকে তাকালাম, হাইপাওয়ার চশমার ভিতর দিয়ে শূন্যদৃষ্টি দুটো চোখ। আমার বন্ধু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ওদিক ফিরে। আবার কাকুর চোখের দিকে তাকালাম। মৃত্যুপথযাত্রার মানুষের পাশে হাঁটলে মৃত্যুর অনেক কাছে এসে দাঁড়াতে হয়। বুঝতে পারি ছেড়ে যাওয়া আর ছেড়ে দেওয়া - কোনোটার জন্যেই প্রস্তুত নই। কোনোদিন হই না। হবও না। কেউ হতে পারে না। মৃত্যু সব কিছুকে ফু দিয়ে ধুলোর মত উড়িয়ে দেয়। আবার নতুন মানুষ নতুন কিছু লিখবে। আপাতত যেন আমার পালা শেষ - মৃত্যু বুঝিয়ে দেয়। যে মানুষটা আমার পাশে বসে, তার জীবনের দীর্ঘ লড়াইয়ের গল্প আমি জানি। কিন্তু এখন সে গল্পর কোনো মানে নেই। গাড়ি চলছে তো চলছেই। আমরা নির্বাক বসে তিনজনে। কি অসহায় অপেক্ষা, যার পরিণতি জানি, কিন্তু সর্বান্তকরণে তা চাই না।

এ বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আজ আবার মনে পড়ল। আজ আমার খুব কাছের এক মানুষের, যে বয়সে আমার চাইতে অনেক ছোটো তার বাবা মারা গেলেন। আবার সেই দীর্ঘ রাস্তাটা মনে পড়ল। সেখানে ক্লান্তি শব্দটাও বড় বেমানান। সেখানে শুধু হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর তো কিছু করার নেই, যতক্ষণ না সম্পূর্ণ অন্ধকার এসে আমায় গ্রাস করে।

দিনটা এই সুরেই বাজছিল। কিন্তু এইতেই শেষ হল কই? একজন বাচ্চার জন্মদিন। আরেকজন বাচ্চার মামাবাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফেরার দিন। সবাই ভীষণ পরিচিত। সবাই খুব কাছের। জন্মদিনের আনন্দ ভাগ করে নিতে হল, কত শুভেচ্ছায়, ভালোবাসায়, আশীর্বাদে। আরেক শিশুর নিজের বাড়ি ফেরার আনন্দের ছবিতে মন উতলা হল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে কোলে নিতে হবে, মন বলল। নিজের মনকে দেখে নিজেরই বিস্ময় লাগে, এত কিছু জমা হয় কোথায়?

ছোটোবেলাটা সালকিয়ায় কেটেছে। ঠাকুমার সঙ্গে গঙ্গা স্নানে যেতাম। গঙ্গা অবধি নামতে গেলে কত সিঁড়ি। কেউ বাসন মাজছে। কেউ স্নান করছে। কেউ কাপড় কাচছে। কেউ পারলৌকিক কাজ করছে। কেউ দ্বিজ হওয়ার পর দণ্ডী ভাসাতে এসেছে। কেউ এমনি এমনিই এসেছে। সিঁড়ি, গঙ্গা - দুই উদাসীন। আমার নিজের মনকে এক এক সময় ওই সিঁড়িগুলোর মত লাগে। সিঁড়ি যেমন জানে না সকাল থেকে কত মানু্ষের কত বিচিত্র প্রয়োজনে তার বুকের উপর পা পড়বে। তার 'না' বলার অধিকার নেই। সে শুধু বুক পেতেই থাকবে, এইটুকুই তার কাজ। সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেলে রাতের অন্ধকারে সে তার সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা আর এক আকাশ তারার দিকে তাকিয়ে সব কিছুর একটা মানে হয় তো খুঁজতে চাইবে। কোনোদিন পাবে না। খুঁজতে খুঁজতে আবার একটা দিন শুরু হবে। আবার নতুন চিত্রনাট্য। একদিন তার সময় ফুরাবে। জীর্ণ হবে। তাকে বদলিয়ে বসবে নতুন সিঁড়ি। তার সমস্ত গল্প যাবে কালের গহ্বরে হারিয়ে তাকে নিয়ে। ব্যস, এইটুকুই তো দাবী জীবনের! প্রতিদিন হাত ভরে নেওয়া যা মেলে, তারপর সবটুকু ভাসিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে হাত পাতা। কিন্তু যদি বলো এসবের তবে সব মিলিয়ে মানে কি হল? কিছু না! জীবন কোনোদিন বলবে না, মৃত্যুও না।