সৌরভ ভট্টাচার্য
14 May 2020
আমি গোগ্রাসে বই পড়তে পারি না। অথবা গোগ্রাসে বই পড়া বা 'ভোরাশিয়াস রিডার' কথাটাও আমার খুব একটা পছন্দের নয়। বই বেছে পড়ি। ভাবনার সাথে যে আত্তীকরণ সঠিক অনুপানে না হয় তবে তার যে কি দুরবস্থা হয় তাও দেখেছি। তখন 'কি পড়ছি' থেকে 'ওরে বাবা কত পড়ছি' কথাটা বড় হয়ে ওঠে। তাতে লাভ কিছু হয় না, অহমিকার পিঠে একটি ফোঁড়াবিশেষ হয় কেবল।
মনের একটা গতি থাকে। সে গতিকে যে বই সমৃদ্ধ করে, সেই সময়ের জন্য সেই বইটিই আমার সবচাইতে প্রয়োজনীয়। তা আমার সেই মুহূর্তের ছন্দের সাথে মেলে। আমার আত্তীকরণটি যথাযথ হয়। ভাবনার মুকুল পুষ্ট হয়। মনের মধ্যে সঠিক সময়ে তার বিকাশও ঘটে।
এই লকডাউনের ঘোর সময়ে আমার মনের উপর দিয়ে যতগুলো বই তাদের শব্দরাজি নিয়ে বয়ে গেল, তার মধ্যে সব চাইতে গভীরে যেটি দাগ কেটে গেল, তা হল নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী। ইংরাজি বইটি ছিলেন কিণ্ডেলে। বাংলা এলেন pdf হয়ে মোবাইলে, ল্যাপটপে।
বইটার অনুবাদ করেছেন সারফুদ্দিন আহমেদ ও ওমর ফারুক। আমার অনুবাদটি চমৎকার লেগেছে। কিছু কিছু জায়গায় সংক্ষিপ্তকরণ হলেও তা পাঠের পক্ষে তেমন ক্ষতিকর কিছু নয় যদি না আমি ম্যান্ডেলা বিশেষজ্ঞ হতে চাইছি। মূল পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬১১, মোটের উপর পাঠককে বঞ্চিত করা তো হয়নি।
ম্যান্ডেলাকে কেন পড়ব? তার উত্তর একটাই, মনগড়া ধারণা থেকে বাঁচার একটাই পথ -- সঠিক ঘটনাটা জানা। তার্কিক বলবেন, উনি যা লিখেছেন তা যে সব সত্যি তাই বা মানি কি করে? উত্তরে বলতে হয় সে গবেষণার পথ তো খোলাই রইল, তবে কোথা থেকে একটা শুরু তো করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে এই বইটির পাঠ একটা অভিজ্ঞতা।
যে কোনো দেশের, যে কোনো সময়ের বঞ্চিত, নিপীড়িত মানু্ষের লড়াইয়ের গল্পটা সেই দেশে, সেই সময়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। ঘরের কোণে প্রবলের অত্যাচার হোক, কি রাষ্ট্রের রাজশক্তির অত্যাচার -- যে শোষিত হয়, নিপীড়িত হয় -- সে একদলের মানুষই হয়, সমগোত্রের মানুষই হয়। তাই এ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যেই সরব হন, তিনি সব কালে, সব দেশের মানুষের নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠেন। কাছের লোক হয়ে ওঠেন। ম্যান্ডেলাও তাই।
মহাত্মা আর ম্যান্ডেলার সংগ্রামের পথ পৃথক। একজন অস্ত্রহীনতার পক্ষে, একজন সশস্ত্র। তাও ম্যান্ডেলার বাড়ির দেওয়ালে মহাত্মার ছবি। কারণ মূল লক্ষ্য এক -- শান্তি প্রতিষ্ঠা। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। ন্যায় ছাড়া মানুষের অন্তর্জগৎ কি বহির্জগৎ -- কোথাতেও শান্তির প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ম্যান্ডেলা সেই চেষ্টাটাই করেছিলেন আমরণ।
ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা নিয়ে দু'ভাবে ভাবা হয়। এক, রামরাজ্য, যা হল চূড়ান্ত ন্যায়প্রতিষ্ঠ শাসনকাল; দুই, আপাতত সামনেই যে অন্যায়, তার প্রতিকারের চেষ্টা। বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয়টিই বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। লিঙ্কন, গান্ধী, ম্যান্ডেলা, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ দেশনায়কেরা একই কথা বলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের নামে যদি কেউ আপত্তি করেন, তবে বলি মহাত্মা রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলতেন তা শান্তিনিকেতনে সাহিত্যচর্চার তালিম নিতে আসতেন বলে নিশ্চয়ই নয়! বাকিটা বুঝে নেওয়াই যায়।
সবশেষে বলি, শিক্ষার কথা। ম্যান্ডেলা বলছেন, 'নেতা যতই শিক্ষিত হোন না কেন, তাঁর উপরে যদি তাঁর দেশবাসীর সমীহ না জাগে তবে তিনি একজন অলস বুদ্ধিজীবী ব্যতীত কিছুই নন।' আরো বলছেন শিক্ষা নিয়ে, একমাত্র শিক্ষাই পারে মানুষের মধ্যে সাম্যের, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে।
এইখানে একটা কথা আছে অবশ্যই। শিক্ষা আর চরিত্রগঠনের একটা সম্পর্ক আছে -- সে কথাটা আমরা ভুলতে বসেছি। কারণ একজন ভারতীয় প্রাজ্ঞ মানুষের ভাষায়, শিক্ষা আমাদের স্মৃতির বলদ ব্যতীত আর কিছু বানাতে সক্ষম হচ্ছে না। আমাদের বোধকে সে উজ্জীবিত করতে অক্ষম হচ্ছে।
দুর্বিনীত, লোভী, মিথ্যুক, আত্মকেন্দ্রিক, অধৈর্য, পক্ষপাতদুষ্ট, অন্তর্দৃষ্টিহীন, সহানুভূতিহীন মানুষ যখন শিক্ষকের আসনে বসে, তখন শিক্ষণীয় বিষয়টি যাই হোক না কেন তা দূষিত হয়েই আসে। তৎক্ষণাৎ তার প্রমাণ না পাওয়া গেলেও ধীরে ধীরে তা সমাজের ভিতকে বিষাক্ত করে তোলে, ঘুণ ধরিয়ে দেয়। যার উদাহরণ আমাদের চারদিকে।
এ বইটি ইংরাজিতে হোক কি বাংলায়, একবার পড়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। কঠিন সময়ই কঠিন সময়কে চেনায়। আজ আমাদের সেইরকমই এক সময়, গোটা বিশ্বজুড়ে।