মন্দিরের সামনে সেপাইয়ের দল। পাগল জিজ্ঞাসা করল, তোমরা এখানে কেন গা?
সেপাই বলল, মন্দিরের ক্ষতি
করতে চায়।
পাগল বলল, কারা গো?
সেপাইয়ের দল বলল, সে আছে, আছে, আছে।
পাগল মন্দিরের সামনে যে
একটা বড় বট গাছ আছে, সেটায় চড়তে চড়তে বলল, বেশ, আমি উঠছি মগডালে।
সন্দেহজনক কিছু দেখলেই বলব।
পাগল গিয়ে বসল মগডালে।
হওয়ায় গাছ দোলে। পাগলও দোলে। দূরে হাল আর গরু নিয়ে আসছে কৃষকের দল। পাগল চীৎকার করে বলল, কৃষকেরা আসছে… ধুলো উড়িয়ে লাঙল
নিয়ে, দলেবলে… ওরাই কি শত্রু মন্দিরের?
সেপাইয়ের দল বলল, আরে না, না, না। সে অন্য কেউ।
পাগল আবার তাকায়।
শ্রমিকের দল আসছে, হাতে নানা যন্ত্রপাতি।
পাগল আবার জিজ্ঞাসা করল, শ্রমিকেরা আসছে
দল পাকিয়ে, হাতে তাদের ধারালো সব যন্ত্রপাতি… ওরাই কি তবে?
সেপাইয়ের দল বলল, আরে না, না, না.. ওরা চলেছে কারখানায়… সে আছে অন্যলোক….
রোদ চড়ে। পাগল ঘামে।
শিক্ষকের দল আসছে, সঙ্গে অনেক বইখাতা, পিছনে আসছে কচিকাঁচার দল।
ধুলো উড়িয়ে।
পাগল বলল, শিক্ষকের দল আসছে
দল পাকিয়ে ছাত্র নিয়ে… ওরাই কি তবে তারা?
সেপাইয়ের দল বলল, না, না, না। ওরা যাচ্ছে
নদীর ধারে, টোল খুলেছে সেখানে।
পাগল চুপ করে বসে।
ইতিমধ্যে ভিখারির দল গেল, মেয়েদের নাচের দল
গেল, শবযাত্রা, বরযাত্রীর দল গেল। সেপাই
বলল, ওরা কেউ নয়, কেউ নয় শত্রু।
পাগলের চোখ জুড়িয়ে
এসেছিল। এমন সময় সন্ধ্যে নামল। সূর্য ঢলছে পশ্চিমে। পাগল দেখছে দিনের শেষ শিখায়
জ্বলে উঠল প্রভুর চোখ। পাগল তার প্রভুর চোখ দেখে হাটে-বাজারে, শ্মশানে-সূতিকালয়ে, আনন্দে-বিষাদে। প্রভুর
চোখ ঢাকে শুধু হিংসায়।
হঠাৎ হাওয়া উঠল। গাছের পাতাগুলো মর্মর করে আওয়াজ করে উঠল।
কিন্তু সেই আওয়াজে পাগল কি যেন শুনলো। সেপাইয়েরা শুনল না। বা শুনলেও বুঝল না।
সন্ধ্যের প্রথম প্রহর।
রাজামশায় আসছে সোনা বাঁধানো রথে। সঙ্গে বালক রাজকুমার। পিছনে সার দেওয়া রাজার
অনুচরের দল।
রথ থামল। পুরোহিত বেরিয়ে
এলো মন্দির থেকে। ধুলোয় ঠেকালো মাথা। রাজা নামল পুরোহিতের প্রণামে ভর দিয়ে। এমন
সময় উচ্চহাস্যে হেসে উঠল পাগল। গাছের পাতাগুলো উঠল থরথর করে কেঁপে।
পাগল বলল, রাজা, কে শত্রু
মন্দিরের?
রাজা বলল, সে অন্যদেশে আছে।
আমাদের দেবতার সে করে অপমান। আমাদের শাস্ত্রের সে করে অপমান।
পাগল বলল, রাজা, তোমার এ
পুতুলখেলা। আর ভয়ও তোমার পুতুলভাঙার ভয়। সে ভয় সাজে সুকুমার রাজকুমারকে, তোমায় কি সে সাজে? তুমি যদি দেখতে
এসে আমার পাশে বসে, তাঁকে দেখতে ক্ষণে ক্ষণে
তোমার আশেপাশে, তোমার মধ্যে বিনাসাজে, বিনা আড়ম্বরে। তার না আছে
ভয়, না আছে শত্রু, নাম তার সত্যময়, নিরঞ্জন। হাত
বাড়ায় সে দীনের প্রেম, অধীন হয় তার, যে ছেড়েছে লোভের
অধীনতা। তুমি লোভী রাজা। তাই পুতুলখেলায় দেশকে রাখো অন্ধ, জাগাও ওদের
প্রাণে জুজুবুড়ির ভয়।
রাজা প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হল।
সেপাইয়ের বন্দুক উঠল গর্জে। নিথর পাগলের দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
রাজকুমার দেখল, মন্দিরে দেবতা
উঠল কেঁপে। দীপের শিখা নিভল। অন্ধকারে কার যেন চোখজোড়া, শান্ত, স্নিগ্ধ, অকুতোভয়। কানে
কানে বলল, পুতুলখেলায়, পুতুলভাঙার ভয়, উড়িয়ে দিয়ে আয়
জগতের মাঝে, জীবন রে তোর কাটাস না অকাজে!