Skip to main content

শ্মশানে থাকে ভোলা। লোকে বলে ভোলা ক্ষ্যাপা। বউ মরে গেল। ভোলা মিস্ত্রী ভোলা ক্ষ্যাপা হল। লোকে বলত ওরকম শান্ত লোক দুটো হয় না নাকি। ভোলার বউও তাই বলত, তুমি ওর গায়ে হেগে দাও, ধুয়ে নেবে, তোমায় কিচ্ছু বলবে না, কিন্তু রাগলে চণ্ডাল।

    কিন্তু সেই ভোলাকে এখন আর কার মনে আছে। প্রায় বিশ বছর হল বউ মরেছে। ভোলার বয়েস কম হল নাকি? কথা বলতে যাও, কোনদিন বলবে, কোনোদিন বলবেই না। এই তো গত মাসে, আমাদের পাড়ার এক বুড়ো মানুষ মারা গেল। শ্মশানে গেছি। দেখি ভোলা নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, একজন বলল, ওইদিকের ঘাটে থাকে এখন রাতে।

    রাত বারোটার কাছাকাছি হবে। রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পাশের ঘাট বেশিদূর নয়। ঠিকই বলেছে, ভোলা বসে আছে গঙ্গার দিকে মুখ করে। জিজ্ঞাসা করলাম, করোনা কি বুঝছ.... সব কি সাবাড় হবে?

    ভোলা হাসল। বলল, দেখ ভাই, সংসারে দুটো জ্ঞান হয়। এক, পেট চালানোর। দুই, নিজেকে ভালো রাখার। আমার প্রথমটা নেই। তোদের এ মহামারী, অতিমারী পড়ি কাগজে, শুনি। কিন্তু বুঝি না। নিজেকে বলি, যা লোকে বলছে তাই করে যা, বাদ বাকি যা হবে তা হবে। মাস্ক পরি শ্মশানে ভিড় হলে, ভ্যাক্সিন নিয়ে এলাম মিউনিসিপালিটি থেকে। লোকে যা বলছে করে যাচ্ছি। আমি মূর্খ মানুষ, ওসব নিয়ে কোনো জ্ঞান নেই রে। তোরা বিজ্ঞান পড়েছিস তোরা জানবি।

    আমি বললাম, তুমি এত সাধন করো, এতে ভবিষ্যৎ জানা যায় না?

    ভোলা বলল, ধুস.. আমি আবার সাধন কবে করলাম... তোরা ভাবিস বাউণ্ডুলে হলেই সাধক, আর দাড়ি গেরুয়া থাকলে তো কথাই নেই। এ সব ভেক। দুটো পয়সা দেয় লোকে, চলে যায়। এইসবই ঢং রে। মুখোশ।

    এইভাবে কুড়ি বছর কাটিয়ে দিলে? তাই হয়? কাজ ছাড়লে কেন?

    ভোলা কিছু বলল না। একটু পর বলল, জোয়ার এলো।

    বেশ কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ। শ্মশান থেকে খোলকরতালের আওয়াজ আসছে। আজ ভিড় আছে। ভোলা একটা বিড়ি ধরালো। আমায় জিজ্ঞাসা করল, ধরেছিস?

    মাথা নাড়লাম। ভোলার মধ্যে একটা শূন্যতা আছে। সব ফাঁকা হয়ে যায় ভোলার পাশে বসলে। ভোলা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বলে সে কিছুই জানে না। কিন্তু এত শান্ত থাকে কি করে সব সময়?

    তোমার একঘেয়ে লাগে না?

    মন বদলে যায় রে। তোর যে মনে এত প্রশ্ন, সেই মন কি আজীবন এক থেকে যাবে? মন বদলে বদলে যায়। তোরও বদলাবে। প্রশ্ন বদলে যায়। সব ঘুরছে দেখিস না। এই পৃথিবী চাঁদ, সূর্য। জীবন মৃত্যু। তোর শরীরের মধ্যে রক্ত। মাথার মধ্যে চিন্তা। সব ঘুরছে। মানুষও ঘুরছে নানা ধান্দায়। আমি তুই সব ঘুরছি। একঘেয়ে লাগালেই লাগে, না লাগালেই লাগে না।

    তোমার কথা আমি অনেক সময় বুঝি না।

    বুঝবি কি করে? তোর মন আর আমার মন কি এক? আলাদা দুটো মন। মানে আলাদা দুটো সময়।

    মন মানে সময় কি করে হয়?

    তা না তো কি? তোর মনে যত প্রশ্ন, যত স্মৃতি, যত ভাবনা, সব একটা সময়কে ঘিরেই তো। এই সামনে পুজো আসছে, এখন তোরা পাড়ার পুজো নিয়ে মাতবি। যখন পরীক্ষা থাকে তখন পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। সবাই তাই রে... মন মানেই সময়। একই জিনিস। তোর এখন আমার পাশে বসে যেমন লাগছে বাড়ি ফিরে আবার অন্যরকম লাগবে। কারণ সময় বদলে যাবে। তাই না?

    তুমি ঈশ্বরকে মানো? মানে দেখেছ?

    বোকা। ঈশ্বর কি জিনিস আবার? নিজেকেই মানুষ জেনে-বুঝে কুল পায় না, আবার ঈশ্বর!

    মানে তুমি নাস্তিক? নাস্তিক সাধু?

    ভোলা হাসল। বলল, নাস্তিক আস্তিক দুই তো বিশ্বাস। ওসব বাইরের কথা। আসলে মানুষ নিজেকে নিয়ে বড় ঝামেলায় পড়ে আছে। এত দ্বন্দ্ব, এত বিরোধ, এত ঘূর্ণি। মানুষ তাই আস্তিক, নাস্তিক খেলা খেলে এসব ভুলে থাকে। রাতদিন তর্ক, ঝামেলা। সব শেষে, সব শূন্য। মানুষ ফুরালো, সব ফুরালো। যাকে পোড়াতে এনেছিস, তার আর কোনো দ্বন্দ্ব আছে? নেই। এবার তোদের খেলা। ঘি মাখাবি। ছাইভস্ম মন্ত্র পড়বি। এই…. এই আরকি…

    তবে তুমি ভাবো কি?

    কিচ্ছু না…..

    ভোলা তাকালো আমার মুখের দিকে। হাসল। বলল, কিচ্ছু ভাবি না।

    কুড়ি বছর ধরে কিচ্ছু ভাবো না?

    নাহ্! কিচ্ছু না। ভাবনার চাদর উড়িয়ে দিয়েছি। কিচ্ছু ভাবি না।

    তবে কি করো রাতদিন? কাটে কি করে তোমার?

    দেখ তবে... কেমন ভাবনার দাস হয়েছিস... কেন রে… ভাবার বাইরে কি কিছুই নেই…

    কি আছে?

    আগে ভাবনার বাইরে আয় তবে তো জানবি…. নইলে যাই বলবো তাই আবার ভাবনার রঙে রাঙিয়ে একটা কিম্ভুত কিছু দাঁড় করাবি….

    বুঝলাম না। আবার কিছু যেন বুঝলামও। বললাম, কি জানি, তোমার কাছে এলে মনটা যেন কেমন শান্ত হয়ে যায়... কেন বলো তো?

    ভাবনাগুলো কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় বলে….

    তবে কি থাকে তখন আমার মধ্যে….

    এই যে নিজেই বললি…. শান্তি….