সুধাকর সামন্ত সুখী মানুষ না। সন্ধ্যেবেলা সরষে ক্ষেতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। প্রায়ই থাকে। লোকে বলে, সুধা অমন অন্ধকারে পা ডুবিয়ে বসে থাকো ক্ষেতে, সাপখোপে কামড়াবে, পোকামাকড় আছে।
সুধা উত্তর
দেয় না। আজও মনে হচ্ছে, সাপের কথা, মরার কথা,
দুঃখের কথা। দূর থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে --- "প্রেমানন্দে
হরি হরিবোল"। সুধাকর মনের ভিতর সাড়া পায় না। একজন মানুষ নেই যে তাকে বোঝে!
হঠাৎ পিঠের
উপর কেউ হাত রাখল। সুধা ফিরে তাকালো। তার নাতি। সে এসে বলল, দাদু আমার অঙ্ক করা শেষ। আমি বসি তোমার কাছে একটু? সুধার
সাপের ভয় করল। পোকামাকড়ের ভয় করল। সে নাতিকে বলল, না দাদুভাই,
তুমি বাড়ি যাও, আমি এখনি আসছি।
নাতি চলে
গেল। সুধা আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে। প্লেন যাচ্ছে একটা। সুধা প্লেনে ওঠেনি। ইচ্ছাও
নেই। অমন বেয়াড়া ইচ্ছা তার হয় না। তার দুঃখ একটাই, তার মনে হয়
তাকে কেউ বোঝে না। আসলে মানুষকে বোঝা কি চাট্টিখানি কথা? মানুষের
মন মাছির মত, উড়ছে তো উড়ছেই.. কখন কোথায় বসবে তার ঠিক আছে?
হঠাৎ কি মনে
হল, সুধাকর উঠে হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। ঘোষেদের বাড়ি কীর্তন
হচ্ছে। সুধাকর রাস্তার পিছনে অন্ধকারে এসে দাঁড়ালো।
একজন
কীর্তনীয়া একটু দূরে ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রকৃতির ডাকে। সে ফিরছে। কপালে চন্দন।
গলায় মালা। কণ্ঠির মালা। মুখে হাসি। কৃত্রিম ভালোবাসার হাসি। এইটা দেখলেই গা জ্বলে
যায় সুধার। মন মাছি। যখন গুয়ে বসে আছে তখন ফুলে বসার ভান কেন করবি? হাসার ইচ্ছা না করলে হাসবি না, অমন দাঁত কেলাবি কেন?
কীর্তনীয়া
এগিয়ে এলো, বলল, জয় নিতাই। সুধাকর কিছু না বলে সটান
তার ডানগালে একটা চড় কষিয়ে দিল।
কীর্তনীয়া
এমন ঘাবড়ে গেল যে কিছুক্ষণ সে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকল সুধাকরের দিকে। তারপর
বলল, ****(গালাগাল)
সুধা হাসল।
এই তো আসল ভাষা বেরোলো। যেখানে মন বসে আছে সেখানের ভাষা। "প্রেমানন্দে
হরিবোল" বলা মুখে এমন কাঁচা খিস্তি শুনে দারুণ লাগল। এই না হলে মানুষের মন!
এই গুয়ে বসবে, এই ফুলে বসবে। যদিও সুধার আজকাল আর ফুলে
বসতে ভালো লাগে না। সব ফুল নকল। বরং গু নকল না। বসে থাক মন গুয়ে।
আবার আগের
জায়গায় এসে চমকে উঠল। নাতিটা বসে। মানে?
সুধা দৌড়ে গিয়ে বলল, এই নেপো, এই... তুই একা বসে কি করছিস….?
নাতি একলাফে
দাদুর কোলে বসে বলল, কই তুমি আসবে বললে তাড়াতাড়ি… এলে না….
চ…
না। বসো।
সুধা বসল।
নাতি কোলে বসে আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, এত তারা কে লাগালো,
তোমার বাবা? না আমার বাবা?
সুধা হেসে
বলল, তোর বাবাই হবে।
নাতি বলল, ওগুলোতে রোজ তেল দেয় কে?
দাদু বলল, আমি আর তোর দিদা।
নাতি বলল, চাঁদ নেই কেন আজ?
দাদু বলল, চড় খেয়েছে।
নাতি খিলখিল
করে হেসে বলল, কেন অঙ্ক পারেনি? না
কাদা মাখিয়েছে প্যাণ্টে?
দাদু হাসল।
নাতি বলল, কে মারল?
দাদু বলল, আমি।
সুধা দেখছে
তার মন মাছি অল্প অল্প করে ফুলে বসতে চাইছে। নাতির গায়ের গন্ধে ফুলের গন্ধ। কিন্তু
মেয়ের বাড়ির নাতি, ক'দিন আর... দু'দিন পরেই বাক্সপেটরা গুটিয়ে নিজের বাড়ি হাঁটা দেবে… মন
হ্যাংলার মত পিছনে পিছনে দৌড়াবে। তারপর পাত্তা না পেয়ে ফিরে আসবে। শরীর ছাড়া মনের
বাস বেশি থাকে না। তাই না এত ফটো টাঙানোর বাতিক মানুষের। ফটোর শরীরে পুরোনো মনের
বাস। মায় ঈশ্বরকেও মানুষ শরীরে চায় কেন? নইলে মন বসাবে কোথায়?
শরীর না পেলেও মসজিদ, গুরুদ্বারা বানিয়ে মন
বসাবে। দেহ ছাড়া মন হয় না।
সুধা নাতিকে
নিয়ে বলল, চ…
নাতি কোলে।
সুধা হাঁটছে। কীর্তন শেষ। কীর্তনীয়ারা জিনিসপত্র গোটাচ্ছে। তাকে দেখেই সেই
কীর্তনীয়া বলল, আরে ওই পাগলটা আবার এসেছে….
বাকি
কীর্তনীয়ারা দৌড়ে এলো। মারবে তাকে। বাচ্চাটা দাদুর গলা জড়িয়ে বলল, ওরা এমন করছে কেন গো?
কীর্তনীয়ারা
বাচ্চাটাকে দেখে কিছু বলল না। একজন মহিলা এগিয়ে এসে বলল, মেরেছিলেন কেন?
সুধাকান্ত
বলল, প্রেমানন্দ খুঁজতে।
নাতি বলল, চাঁদ কি এদিকে থাকে?
দাদু বলল, এই যে, ওর গালে একটা চুমু দাও দেখি…
নাতি মুখ
বাড়ালো। মহিলা কীর্তনীয়ার গালে চুমু খেলো।
সুধাকর
নাতিকে মহিলার কোলে চাপিয়ে, চড় খাওয়া কীর্তনীয়ার কাছে এসে বলল, প্রেমানন্দ এসেছে? সত্যি বলো দেখি...
কীর্তনীয়া
বলল, জানি না।
সুধাকর বলল, তবে? গাও যে বড়…
কীর্তনীয়া
বলল, গাই... টাকা পাই... পেট চলে...গাইলে মান দেয় লোকে, তাতে একটু আনন্দও হয়….
সুধাকর বলল, তারপর আবার যে-ই কে সে-ই তো?
কীর্তনীয়া
গালে উদাসভাবে হাত বুলিয়ে বলল, সে আর বলতে?
সুধাকর বলল, ঠিক। প্রেমানন্দ আর আমাদের মত মানুষদের কোথায় বলো? তাও
মানুষকে কিছু একটা দিয়ে তো ভুলিয়ে রাখতে হয়। বুঝি বুঝি। তবু মাঝে মাঝে মাথাটা বড়
গরম চরকির মত হয়ে যায়। তাই আরকি... পরে খুব লজ্জা লাগে, ভীষণ
লজ্জা... দেখো মানুষকে আপন করার অনেক নিয়ম আছে। অমন আন্তরিক চড়টা না মারলে হয় তো
তুমি এত আপন করে কথা বলতে না। ও তো রাগের চড় না বলো, ও হল
গিয়ে আন্তরিক চড়। তবু আমার লজ্জা লাগল। তোমার ওদিকে রাগ হল। সেই স্বাভাবিক। ব্যস,
দু'জনেরই সামাজিক অহংকার গেল। নইলে এমনি এমনি
ভক্ত সেজে এসে "প্রেমানন্দের কথা" জিজ্ঞাসা করলে তুমি খানিক শাস্ত্রের
হাবজি গাবজি বলতে। তাই না?
কীর্তনীয়া
প্রথমে কি বলবে ভেবে পেলো না। খালি হাসল। তারপর বলল, তবু নিজেকে
সামলে রাখবেন।
সুধাকর বলল, মন তো মাছি। এমনি মাছি গুনগুন করে না, মন মাছি করে।
গুনগুন, ক্যাঁওম্যাঁও, হুমহুম... আরো
কত কি করে! নেশা লাগে। চেতনা হজম হয়ে যায়। তখন কি করি ঠাহর করতে পারি না…
কীর্তনীয়া
আর কথা বাড়ালো না। সুধাকর নাতিকে কোলে নিয়ে বলল, চলো দাদুভাই.
মনটা আবার উড়ে যাওয়ার আগেই বাড়ির রাস্তাটা চিনে যাই…..
নাতি বলল, ওই দেখো দাদু একফালি সাদা তরমুজের মত চাঁদ উঠেছে…
দাদু বলল, ওঠে রে, ওঠে, ওর সময় মত ওঠে...
যখন তখন চাই বলেই এত ক্ষোভ…
নাতি বুঝল
কিনা জানি না। সে দাদুর কোলে মাথা রেখে জোনাকি আর চাঁদের আলোয় মাখা তারাদের দেখতে
দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল...