রান্না করতে সকাল থেকেই ইচ্ছা করছে না। সকাল থেকে শুয়ে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সারা শরীর দিয়ে মনে হচ্ছে পোকার সারি হেঁটে যাচ্ছে। জানলাটা খোলা। রাস্তা পাশে। দিনদুনিয়া তার মত জেগে। কত উৎসাহ মানুষের। তার কিছুতেই কোনো উৎসাহ নেই। এরকম মাসের পর মাস চলে। তবু নিজেকে টেনে হিঁচড়ে স্টেশানে নিয়ে যায়। ট্রেনে ওঠায়। গলায় জোর এনে চীৎকার করে, দিলখুশ… দিলখুশ… গরম গরম… এখনই খান… বাড়ি নিয়ে যান… টাটকা দিলখুশ…
খড়দা স্টেশানে বসে। একটা কেক আর চা ছাড়া সকাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি। পাঁচটা ট্রেনে কাজ করেছে মাত্র। গাছের পাতাগুলোর শব্দ আসছে। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। ইচ্ছা করছে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে গেলেই অন্যজগৎ। তখন ঘরবার কই। তার সাতকূলে কেউ নেই। সে যেন হাওয়া থেকে জন্মেছে। মাটি ফুঁড়ে। খিদে পাচ্ছে।
চেনা ভাতের হোটেল। চেনা ট্যালটেলে ঝোল, ডাল, মাছভাজা, জল। সব বিস্বাদ। ভাতের দানাগুলো রঙচটা। সাদা হতে হতে হলুদ হয়ে গেছে। জিভের উপর রাখলে ওরা বলে তাড়াতাড়ি গিলে ফেলো। লজ্জা দিও না। হোটেলের মালিক কথা বলে না। কানের উপর লোম। সুগারে খাওয়া শরীর। লোভ না মেটা চোখ। আঙুলগুলো শিকলের মত।
তার লোভ হয় না। শুধু বাঁচতে ইচ্ছা করে। এই লাইনে কাজ করতে করতে কতবার কাটা মাথা দেখল। দুঃখ হয়। ভীষণ কষ্ট হয়। আগে আগে গা পাক দিয়ে উঠত। এখন কিছুই হয় না। শুধু মনে হয় বাঁচতে পারত হয় তো। তার আবার বাঁচতে ইচ্ছা করে। মন সায় না দিলেও বাঁচতে ইচ্ছা করে। মনের মধ্যে ডুব দিয়ে পান্না কুড়িয়ে এনে জীবনকে সাজাতে ইচ্ছা করে। সংসারে কোনো সুখের দাবী সে করে না। কিন্তু বাঁচার অধিকারটুকু ছিনিয়ে নিতে এলে সে হিংস্র হয়ে ওঠে।
আবার স্টেশানে এসে বসল। নৈহাটি লোকাল আছে একটা ডাউনে এখন। দমদমে নেমে যাবে। নৈহাটি লোকালের কথা মাইকে বলল। আসছে তবে।
চোখ আটকালো আপের প্ল্যাটফর্মে। বুঁচকি না?
বুঁচকি তাদের পাড়ার মেয়ে। বিয়ে হয়েছে এদিকেই কোথাও। কিন্তু ও এরকম একা একা প্ল্যাটফর্মে ঘুরে কেন বেড়াচ্ছে? অবশ্য তার তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু বিবাহিত মেয়েদের দেখলে তার হিংসা হয়, ঈর্ষা হয়। মনে হয় সে তো তারও হতে পারত।
প্ল্যাটফর্ম চেঞ্জ করে বুঁচকির সামনে দাঁড়ালো। বুঁচকি থতমত খেল। ভয় পেলো যেন। তাকে দেখে বলল, খোকনদা, তুমি?
খোকন বলল, এখানে কি করছিস? বাড়ি যাবি?
বুঁচকি আমতা আমতা করছে। চোখ দুটো এত নরম হয়ে আছে যেন আঙুল দিলে বুক অবধি ডেবে যাবে। মনের সব কথা বেরিয়ে আসবে।
কিছু হয়েছে তোর?
বুঁচকি বোকার মত হেসে বলল, কি হবে আবার?
তোর শ্বশুরবাড়ি কোথায় যেন?
বেলঘরিয়া।
তবে?
তবে কিছু না, তুমি যাও… আমি ঠিক আছি…
না রে, আমার যেন মনে হচ্ছে তুই কিছু একটা বদ মতলবে এসেছিস…
বুঁচকি হেসে বলল, তুমি ঠেকাতে পারবে? কতক্ষণ পাহারা দেবে আমায়? তুমি বিয়ে করেছ?
না রে, মরতে মরতে বেঁচে ফিরলাম করোনায়…
হ্যাঁ গো, এই রোগটা যে কি করে দিল… ওর কাজটা নেই জানো... বাড়িতে বসে…
খোকন বলল, চা খাবি?
বুঁচকি বলল, চলো।
*********** *********** *********
কি বলো তো খোকনদা, আমি ভেবেছিলাম সাময়িক, কেটে যাবে। সাইকেলে করে গার্ডেনরীচ এই বেলঘরিয়া থেকে রোজ যাওয়া যায় বলো? অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। চোখমুখ শুকিয়ে একশা গো!
বুঁচকির শুকনো চোখে অল্প অল্প জল। চায়ের চিনিটা বেশি দিয়েছে। খোকন উঠল। দুটো বাপুজি কেক আনল। বাপুজি কেক তার বাবা-মায়ের মত। পেট ভরিয়ে আসছে সেই ভিক্ষা করে খাওয়া দিনগুলো থেকে। তারপর সাইকেলের দোকানে কাজ, হোটেলে কাজ, মিষ্টির দোকানে কাজ, মদের দোকানে কাজ। সকালবেলায় পেট ভরিয়েছে এই বাপুজি কেক। মায়ের আঁচলের মত শান্তি লাগে ভাবলে। মায়ের আঁচল কি জানে না, কিন্তু প্রাণ ঠাণ্ডা হওয়া শান্তি মানে মায়ের আঁচল।
বুঁচকি কিছু না বলেই হাত থেকে নিলো। মেয়েটা ভাবছে। চোখের জলটা গিলে ফেলেছে। খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ খায়নি। ভাতের পর কেক, নামছে না গলা থেকে। খোকন অল্প এক টুকরো কামড় বসালো। ডাউনে দুটো ট্রেন চলে গেল। নৈহাটি আর কৃষ্ণনগর। অনেকেই দিলখুশ খেতে পারত।
এখন কি করে চালাচ্ছিস তবে? বাচ্চা আছে না তোর একটা…
হ্যাঁ গো, এইটে পড়ে, ছেলে... টানতে পারছি না জানো…
এখন?
একটা নার্সিংহোমে কাজ নিয়েছি… ব্যারাকপুরে…
কোন নার্সিং হোম?… ব্যারাকপুরে আমার চেনা অনেক বন্ধু আছে রে…
বুঁচকি যেন অপ্রস্তুত হল। কেকটা গলা দিয়ে নামতে গিয়ে এক মুহূর্ত আটকে গেল। তারপর ঠেলে নীচে পাঠিয়ে বলল, উজ্জ্বল নার্সিং হোম।
খোকনের মনে হল উজ্জ্বল নার্সিং হোম বলে ব্যারাকপুরে কিছু নেই। তবে কি? পুরুষ বলেই কি এই চিন্তাটা সহজে এলো মাথায়? তবে এমন সেজেছে কেন? এত তো সাজে না? কিন্তু এখন তো দিনের বেলা। কি ভাবছে… এরকম ভাবনা কেন মাথায় আসে?
বুঁচকি বলল, খোকনদা তোমার কাছে দু'হাজার টাকা হবে?... ছেলেটার কিছু বই কিনতেই হবে গো…
খোকনের মনে হল দেওয়া উচিৎ। বলল, কিন্তু এখন তো নেই রে। তুই কাল এই সময়ে এখানে আয়, আমি আনব।
বুঁচকি বলল, বাবাকে কিছু বোলো না।
খোকন 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না। দু'জনেই চুপ করে বসে। কাক ডাকছে গাছের কোনো ডালে বসে। স্টেশানে রোদের হলকা আসছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আবার খোকনের। করোনার পর থেকেই এটা হয়েছে। কিন্তু বুঁচকি। শুধু বুঁচকি কেন? এরকম সাজের মেয়ে তো সে দেখেছে। রাতও কাটিয়েছে। এরকম সেজে দুপুরে কে নার্সিংহোমে যায়? এরকম সাজা মেয়ে দেখলেই মানুষের ওরকম মেয়ে মনে হয়। এত মোটা লিপস্টিক। চোখের উপর এরকম চকচকে রঙ। কানের এত বড় চাকা দুল। শাড়িটাও তো কেমন। সব দেখা যায় স্পষ্ট। সায়া ব্লাউজ সব।
চমকে গেল। ঝাঁকুনিতে কাত হয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে। বুঁচকি চলে গেছে। চায়ের দোকানে টাকাটা দেওয়া হয়নি। খোকন উঠে প্যাণ্টের পকেট থেকে টাকাটা বার করে দিতে গেলে দোকানি বলল, আপনার বোন দিয়ে গেছে।
বোন? বুঁচকি বোন? না-ও তো হতে পারত।
********** ***********
পর পর এক সপ্তাহ খোকন দু'হাজার টাকা নিয়ে স্টেশানে এসে বসে থাকল। বুঁচকি এলো না। খোকন ওর বাড়িতেও কাউকে কিছু বলল না। কিন্তু বুঁচকির ঋণটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। দিন দিন জ্বালাটা বাড়িয়ে যাচ্ছে। বুঁচকিকে আবার দেখতে চায়। সে কিছু সেরকম পাড়ায় গেল। মন নীচে নেমে যায় কত সহজেই। বুঁচকিকে খুঁজছে সে। সেকি দু'হাজার টাকার মূল্য কিনতে চাইছে? এত নীচ ভাবনা কি করে জন্মায় মনে? কিন্তু জন্মাচ্ছে তো। পাপ, পাপ। কিন্তু পাপ ছাড়া এতবড় জীবনে দেখলই বা কি সে? অল্প পাপ আর বেশি পাপ। পাপ ছুটি দিলে মনে পুণ্যের হাওয়া। কিন্তু পাপ ছুটি দিলে তো?
বুঁচকিকে দেখল। তবে কোনো সেরকম পাড়ায় না। দক্ষিণেশ্বরে। একদিন সন্ধ্যেবেলা। অন্ধকারে গঙ্গার ধারে ঝুঁকে বসে। পাশে একজন পুরুষ। বুঁচকিকে জড়িয়ে। বিশ্রীভাবে জড়িয়ে। মানুষ ভালোবাসলে ওভাবে জড়ায় না।
খোকনের পা এগোলো না। মন এগিয়ে গেলো। ফিরে এসে চড় মারল নিজের গালে। খোকন চলে এলো। রামকৃষ্ণদেবের ঘরে বসে বড়লোকেরা। ঢুকতে লজ্জা লাগে। ওরা চোখ বন্ধ করে ধ্যান করে। ধ্যান মানে কি? মা কালীর সামনে দাঁড়ালো। প্রণাম করল। প্রার্থনা করল। বুঁচকির জন্য, ওর বরের জন্য, ওর বাচ্চার জন্য প্রার্থনা করল। মনটা শান্তি লাগল। বাপুজি কেকের মত শান্তি।
গঙ্গার ধারে বসল। লোকটা কি বুঁচকিকে নিয়ে এইখানেই শোবে? নাকি ওর জায়গা আছে অন্য? আশ্চর্য, শরীরে কোনো তাপ জন্মালো না। মনের মধ্যে কান্না জন্মালো। যেন লাইনে শুয়ে ধড়টাকে আলাদা করে দিলেই হয়। এত লজ্জা নিয়ে মানুষ বাঁচে কি করে? তবু বাঁচতে ইচ্ছা করে। ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছা করে। খোকন উঠল। পকেটে অনেক খুচরো। মন্দিরের বাইরে বসা সার দেওয়া ভিখারিদের একে একে দিল। মায়ের কাছে প্রার্থনা করল, ওরা বাঁচুক, সবাই বাঁচুক।
খোকনদা?
চমকে ফিরে তাকালো খোকন, বুঁচকি তার দিকে তাকিয়ে। আশেপাশে লাল টি-শার্ট পরা কালো লোকটা কই?
খোকন বোকার মত হাসল। বলল, তুই এখানে?
বুঁচকি বলল, মাঝে মাঝে আসি গো… আজ ছুটি কাজের তাই…
খোকন বলল, চল কচুরী খাবি? তোর কাছে আমার এমনিই ঋণ আছে চা আর কেকের…
বুঁচকি বলল, ছাড়ো তো… চলো কচুরী খাই…
পাশাপাশি বসল। বুঁচকির গা থেকে উগ্র সেন্টের গন্ধ। যেন পুরুষের ঘামের গন্ধও। খোকন পকেট থেকে টাকাটা বার করে দিয়ে বলল, এটা রাখ।
বুঁচকি বড় বড় চোখ করে বলল, না গো… হয়ে গেছে ওটা…
খোকনের ভুস করে কান্না পেয়ে গেল… যেন কানের কাছে বলে গেল কেউ, কি করে হল জানিস তো খোকন… খোকন বলল, তবু রাখ…আমি তোর দাদা না?
মন্দিরে আরতি হচ্ছে। ঠাকুরের ঘরের সামনে কারা গান গাইছে, 'খণ্ডন ভব বন্ধন'… এই সুরটা শুনলে ভালো লাগে… আরাম লাগে… মরতে ইচ্ছা করে না… সবাই বাঁচুক…খোকনের কচুরী কান্না ভিজে গলা দিয়ে নামছে। বুঁচকি কথা বলছে না। না বলুক। কিছু কথা নিঃশব্দেরাও বলুক। বুঁচকি তুই বাঁচ, তোর ছেলে-বর বাঁচুক। শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে পবিত্র কাজ জগতে কিছু নেই রে। শরীর তো ধুলেই পরিষ্কার। মন বাঁচুক জলের স্রোতের মত। সব ভেসে যাক। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাক।