সকালবেলা আমি আর মামু খেতে বসব। জলখাবার আরকি। চাউ হয়েছে। হঠাৎ দেখি মামু দুটো কাঠি নিয়ে খেতে বসল। আমি প্রথমে ভাবলাম সদ্য পুজো গেল, মামুর কি কোনো ঢাকির সঙ্গে প্রেম হল? স্মৃতি স্বরূপ দুটো কাঠি নিয়ে ঘুরছে? মানে ঢাক বাজানোর কাঠি আরকি। হতেই পারে, মানুষ কত কি নিয়ে ঘোরে প্রেমে পড়লে। আমি তো কদ্দিন রুমাল নিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। একদিনও প্রাণে ধরে জিজ্ঞাসাও করিনি, ওগো প্রিয়া, তুমি ইহাতে নাক মুছিয়াছ, সর্দি কি রাখিয়াছ ঝাড়িয়া?
যা হোক। মামু বসে। পাশে কাঠিদ্বয়। সামনে আমি। গল্প করছি। খাবার এলো। মানে চাউ। ওমা! হঠাৎ দেখি মামু ওই কাঠি দুটো দিয়ে গবগব করে চাউ খেতে শুরু করল।
আমি খাব কি? হাঁ করে তাকিয়ে। কাঠিতে এত কিছু ওঠে? দুটো কাঠিকে এমন বশে আনল কি করে মামু? কাঠি দিয়ে ঢাক বাজানো যায় এদ্দিন জানতুম। কিন্তু একি কাঠির ব্যবহার! টিভিতে সিনেমায় দেখেছি। একবার কলকাতায় এক চাইনিজ হোটেলেও খাবারের পাশে অমন কাঠি দিয়ে গিয়েছিল সে অভিজ্ঞতা আছে। আমি আর সে কাঠি নিয়ে নিজের মান-ইজ্জতে কাঠি করিনি। কিন্তু মামুর এই কাঠি সহযোগে ভক্ষণের কারণ কি? বিটিএস। এক কোরিয়ান গাইয়ে-নাচিয়ের দল।
এক সময়ে ছোটোবেলায় কাঁটা চামচে খেতে না পারলে লোকে অসভ্য বলত। কাঁটা চামচ ধরানোর এটিকেট শেখানোতে কত কত নাক উঁচু মানুষ এমন ঘাড় উঁচু করে থাকত যেন ডানদিক ফিরলেই সোজা ইউরোপ আমেরিকা ছাড়া কিছু চোখেই পড়ে না তাদের। সেদিন হলিউড ছিল, সাহেবী মালিকের স্মৃতি ছিল। অনেকের আবার যুক্তি ছিল ব্যাপারটা ভীষণ হাইজিনিক। যেন এদ্দিন ভারতের সব লোক ওলাওঠা হয়ে মরেছে হাত দিয়ে ভাত মেখে খেতে গিয়ে। আবার কেউ কেউ বলেছে, উঁহু রবীন্দ্রনাথও তো খেতেন কাঁটা চামচে। তা বাপু রবীন্দ্রনাথ তো অনেক কিছু করতেন সবটা কি পারিস?
কিন্তু মামুর কেস অন্য। সে নাকি আর্মি। কিসের আর্মি? বিটিএস এর। আমার বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও আর্মি। সঙ্গীতে যোদ্ধার কি দরকার বুঝলাম না। কিন্তু মামুর দৃঢ় বিশ্বাস ভক্তি দেখে আমিও বললাম, আহা কি ভালো কথা! আর্মি হওয়া তো দারুণ ব্যাপার। তারপর বিটিএস এর গান শুনলাম, থুড়ি দেখলাম। পুরুষ নারী পৃথক করা যে এমন কঠিন কাজ সে বোধে এলেও মুখে আনলাম না। শুনেছি মামু ভীষণ গর্জে ওঠে ওসব বললে।
একবার বিটিএস এর কোন গায়কের জন্মদিন। মামু কেকটেক কেটে সেলিব্রেট করবে। গায়কের নাম "যে হোপ"। তা দাদা, মানে জামাইবাবু জিজ্ঞাসা করেছেন, কার জন্মদিন? মামু বলেছে যে হোপ। দাদা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, মানেটা কি? যে হোকের (হোপটা হোক শুনেছে দাদা) একটা জন্মদিন করছিস? নামই জানিস না? মামু তারপর বুঝিয়ে বলল, বাবা ওর নামই "যে হোপ"। তো দাদা তো একটু পুরোনো ভাবধারার মানুষ। তায় একমাত্র মেয়ে। এমন ভিনদেশী পুরুষের জন্মদিন পালন করছে, ব্যাপারটা কেমন কেমন না? দিদি আবার বোঝালো, আহা তা কেন? আমিও তো ছোটোবেলায় কত পুতুলের বিয়ে দিয়েছি। পাড়ার লোক খাইয়েছি। মায়ের উপর কম অত্যাচার করেছি? এও সেই ধারার একটা ধরে নাও না! দাদা এ যুক্তিতে কতটা আশ্বস্ত হল বলতে পারি না। তবে 'যে হোক' এর জন্মদিন পালনে আর আপত্তি জানালো না।
এখন সঙ্গীতের প্রভাব যে খাদ্যখাবারে এসে পড়ে শুধু না, খাওয়ার পদ্ধতিতেও এসে পড়তে পারে এ নিয়ে ধূর্জটিবাবুর কোনো গবেষণা আছে কিনা বলতে পারি না। নিশ্চয়ই এই নিয়েও গবেষণা হওয়া উচিৎ বইকি। তবে ভয় একটাই, বামুন বাড়ির মেয়ে, কোনোদিন বিটিএস আর্মিদের গরু-শূকর খাওয়ায় প্রতিযোগিতা হয়ে পড়ে যদি সেদিন কি হবে! অত্যাধুনিকরা বলবেন, খাবে? এতে আর কি আছে! কিন্তু যে জন আছেন মাঝখানে? তাদের কি হবে? তখন?
সে থাক। এমনিতেই দেশের আবহাওয়া এইসব নিয়ে মাঝে মাঝে মাঝেই গরম হয়ে যায়। কিন্তু সঙ্গীতের সঙ্গে রসনার যে একমাত্রিক যোগ নেই, সঙ্গীতের রস ও রসনা তৃপ্তির রস যে একই যোগে রসনা বেয়ে হৃদয়ে ও উদরে প্রবেশ করে এ জেনে বড় তৃপ্ত হলাম। এ অবশ্যই গবেষণার বিষয়।