চারটে দেওয়ালের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল, তাদের মধ্যে সামাজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুজন, বিপিন আর মল্লিকা। আর কিছু টিকটিকি, আরশোলা, মাকড়সা, পিঁপড়ে, এরা এসেছে গেছে, নিজের আয়ু সবাই পূর্ণ করে যেতে পেরেছে তা ঠিক নয়, তবে কেউ কেউ পেরেছে। বিপিন ছাদ, বাথরুম, শোয়ার ঘর, বসার ঘর, পুজোর ঘর ছেড়েছে অনেক দিন হল। এখন একটা ফ্রেমে শীতগ্রীষ্মবর্ষা এক মুখভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সে মুখটা দেখে ঠিক সুখ না দুঃখ বোঝা যাবে না। অথচ বিপিন সারাটা জীবন শুধু একটা নিখাদ মানসিক সাম্যাবস্থা চেয়েছিল। প্রথম জীবনে কথামৃত, গীতা, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট প্রমুখ মহাপুরুষদের বাণীতে নোঙর বেঁধে, পরের জীবনে রামদেব, রবিশঙ্কর প্রমুখের শেখানো আসন, প্রাণায়াম ইত্যাদির অভ্যাসে - কিন্তু নোঙর একটু হাওয়াতেই খুলে এসেছে। সেটা মাটির আলগাপনায়, না নোঙরের কাঙালপনায় বিপিন সারা জীবন বুঝে উঠতে পারেনি। নিজের শান্ত অবস্থাটা কখনওই বিপিনের আকাঙ্ক্ষিত শান্ত অবস্থার অনুরূপ হল না। বিপিন জীবনে যা পেল না, এই ফ্রেমের শাসনে ঘেরা ছবি, সে ক্ষোভ মিটিয়ে দিয়ে গেল।
মল্লিকা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। মল্লিকার এ রোগ জয়ন্ত জন্মাবার পর থেকেই। জয়ন্ত তাই মাসির বাড়ি মানুষ। নিঃসন্তান মাসি আর মেসো তাকে বড় করে, বিয়ে দিয়ে, জাপানে পাঠিয়ে নিজেরাও পরলোকে গেছে। জয়ন্ত খুব একটা দেশে ফিরতে চায় না। তাই মল্লিকার নিজের সন্তান বলেই হয় তো জয়ন্তকে পরলোকবাসী না ভেবে ইহলোক আর পরলোকের মধ্যেখানে কোনো জায়গায় ভেবে নিয়েছে।
মল্লিকার এখন রাত হলেই ভয় হয়। জীবনে এমন কোনো পাপ করেনি বা লোভ বেঁচে নেই যে ঈশ্বরের দরকার হবে সিরিয়াসলি। আর ভূতের ভয় কোনোদিন নেই। রাতের আয়া, দিনের আয়া শুধু মল্লিকার শরীরের দরকারেই আসে যায়, মল্লিকা কথা একদম বলে না, তাই মনের সঙ্গীর দরকার হয় না। মল্লিকা নয় তাকিয়ে থাকে, নয় চোখ বন্ধ করে থাকে, নয় আধা চোখ খোলা অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকে। তবু মল্লিকার ভয় হয়।
মল্লিকার চোখের সামনে যে দেওয়ালটা, হালকা গোলাপি রঙের, সেই দেওয়ালে একটা গাছের ছায়া পড়ে। জালের মত ছায়াটা সারা দেওয়াল জুড়ে থাকে। গাছটা বাড়ির পাশের রাস্তার ওদিকে, স্ট্রিট লাইটের সামনে। ছায়াটা প্রাচীন। মল্লিকার শিরা উপশিরা, স্নায়ুগুলোর থেকেও প্রাচীন। বিপিন যে রাতে পাশের ঘরে আত্মহত্যা করেছিল, গলায় দড়ি দিয়েছিল, সেই রাতে শুধু পড়েনি। স্ট্রিট লাইটটা খারাপ ছিল। বিপিনের পায়ের তলা থেকে টুলটা ফেলে দেওয়ার শব্দ, গোঙানির শব্দ, ছটফটানির শব্দ শুনেছিল। মল্লিকা চোখ বন্ধ করে দেওয়ালের ছায়াটাকে খুঁজেছিল। পায়নি। একটু পর সব শান্ত হয়ে গেল। ভোরের দিকে একটা চড়াই পাখি জানলা দিয়ে ঢুকে মেঝেতে লাফাতে লাফাতে পাশের ঘরে গেল। মল্লিকা শ্বাস রোধ করে অপেক্ষা করল, চড়াইটা ফিরে আসুক। তার গায়ের উপর বসুক। কিন্তু পাখিটা ফিরল না। ওদিকে খোলা জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, না হারিয়ে গেল?
মল্লিকাকে বিপিন বলেছিল, তোমার ভালোবাসা তোমার শরীর মনের সমস্ত রসে জারিয়ে ওঠে, তাই এত ঝাঁঝ, এত কড়া। তোমার ভালোবাসা তাই শান্ত নয়, স্নিগ্ধ নয়। মল্লিকা শান্ত ভালোবাসা খুঁজেছিল। নিজেকে তোলপাড় করে ঘেঁটে খুঁজেছিল। পায়নি। “তুমি নিজেকে শান্ত করো মল্লিকা, নইলে নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও পুড়িয়ে ফেলবে। তুমি ঈশ্বরে মন দিয়ে নিজেকে শান্ত করে ফেলো”, বিপিন যীশুখ্রীষ্টের আলখাল্লা পরে বলেছিল। না লুঙ্গি আর খালি গা তো, আলখাল্লা তো নয়!
মল্লিকাকে ঈশ্বর শান্ত করেনি, করল এক স্নায়ুঘটিত রোগ। বিপিন শান্ত হল কই? সে মাঝে মাঝেই আলখাল্লা খুলে ল্যাংটো হয়ে দাঁড়াতো, তার দিকে এগিয়ে আসত মাংসের দোকানের পাশে জীবন কাটানো কুকুরের মত শান্ত, অচঞ্চল পায়ে। তার অসাড় শরীরেও চড়াও হয়ে তার জারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজত। মল্লিকার চোঙা ফাটানো হাসি পেত। হাসতে পারত না। বায়ু বেরিয়ে যেত। তখন তার বুক ভর্তি ভালোবাসা শুকিয়ে পেট ভর্তি গ্যাস জমে দিন রাত্রি। মল্লিকার মনে হত বিপিন আর ঈশ্বর একসঙ্গে চড়াও হয়েছে তার উপর। একজন সুখ খুঁজছে, আরেকজন শান্তি।
মল্লিকার সারা বাড়ি জুড়ে এখন মল্লিকারা ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলায় দেওয়াল বেয়ে নামে, ওঠে, হামাগুড়ি দেয়। ফিসফিস করে কথা বলে। মল্লিকার অসাড় শরীরটা টানতে টানতে বড় রাস্তায় নিয়ে আসে। রাস্তার উপর শুইয়ে দেয়। আকাশ থেকে আলগা তারাগুলো খুলে খুলে তার গায়ে লাগায়। বড় পুকুরের জলে স্নানে নামায়। যে পুকুরের ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে দেবতারা। সবাই উলঙ্গ। তারা তীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জলের মধ্যে তরঙ্গ তোলে। সারা শরীর জুড়ে ঢেউ খেলে যায় মল্লিকার। তারা মন্ত্র পড়ে। পুকুরের মধ্যে ডুবে যায় মল্লিকা। তার চারদিকে চারামাছের মত মল্লিকারা গুঞ্জন করে। মল্লিকা পুকুরের নীচে মাটিতে এসে শোয়। মাটির উপর ছড়ানো উলের কাঁটা, হাতাখুন্তি, ছোবড়া, সাবানের কেস আর চুলের কাঁটা।
মাঝে মাঝে গ্যাস জ্বেলে মল্লিকার শরীরটা তার উপরে রেখে দেয়। তার আত্মীয়স্বজনেরা কাঁটা চামচ হাতে খাবার টেবিলে বসে। তাদের চাপাস্বরে কথা বলার ঘ্যাষঘেষে আওয়াজ পায় মল্লিকা। তাদের লালারস তাদের গাল গড়িয়ে, গা গড়িয়ে, চেয়ার গড়িয়ে রান্নাঘরে এসে ঢোকে চূর্ণীনদীর স্রোতের মত, যে চূর্ণীনদীর ধারে বিপিন প্রথম মল্লিকার বুকে হাত রেখে বলেছিল, তোমায় ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন।
কখনও মল্লিকারা মল্লিকাকে নিয়ে ছাদের কাপড় শুকানো তারের সঙ্গে মেলে দেয়। মল্লিকার অসাড় শরীর হাওয়ায় ভাসে। ক্লিপ আটকানো সুখের মত। মল্লিকা উড়ে যায় না তাই। আকাশজুড়ে ঘন কালো মেঘ আসে। মায়ের মুখের মত আদর নামে টবে, ছাদে, কার্নিশে। একটা কাক উড়ে আসে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদ থেকে, সারা গায়ে চকের গুঁড়ো মেখে। বৃষ্টি নামে। মল্লিকার সারা শরীর ধুয়ে যায়। কাকের গা থেকে চকের গুঁড়ো গলে গলে সারাটা ছাদ মেখে যায়। মল্লিকারা তাদের ছোটো ছোটো পায়ে সেই চক মাখা ছাদের উপর কিতকিত খেলে। মল্লিকার এলোচুলে হাত বুলাতে নামে সন্ধ্যাতারা।
মল্লিকা ভয় পায়। সকাল হলে আজকাল একটা একলা শালিখ রোজ এসে বসছে জানলায়। মল্লিকা জানে ও কেন আসছে। কিন্তু মল্লিকা যেতে চায় না। কোথাও যেতে চায় না। না স্বর্গে, না নরকে, না ঈশ্বরের কাছে, না শয়তানের কাছে, না মানুষের কাছে। মল্লিকা এই ঘরে এইভাবে অনন্তকাল শুয়ে থাকতে চায়। আর চায় তার থেকে জন্মানো অসংখ্য, অজস্র মল্লিকারা তাকে পাহারা দিক। তারা সূর্যের পরিধি বরাবর ঘুরুক। তারা চাঁদের কালো কালো খোপগুলোর মধ্যে বাসা বাঁধুক, ঝিনুক লুকিয়ে রাখুক। চাঁদের আলোয় মুক্তো বানিয়ে তার চুল বেঁধে দিক। তার কাছে যেন কেউ না আসে, কেউ না। মল্লিকা শালিখটাকে বলতে চায়, হুস! পারে না। তাকিয়ে তাকে। পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চায়, পারে না। চোখের কোল বেয়ে জল নামে। দিনের আয়া চোখের জল মুছিয়ে মুছিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কাঁদছ কেন ঠাকুমা, কষ্ট হচ্ছে? খিদে পাচ্ছে? ছেলের জন্য মন খারাপ করছে? হিসি করে ফেলেছ? হাগু করবে?
মল্লিকা পা তুলে লাথি দেখাতে চায়, পাটা ওঠে না। শুধু বায়ু বেরিয়ে আসে।