Skip to main content
majhe majhe

মাঝে মাঝে এমন কিছু অবস্থায় পড়তে হয় যার বিন্দুমাত্র পূর্বাভাস থাকে না। মেলা হচ্ছে। নানাবিধ নাগরদোলা ঘুরে যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে, দেখতে বেশ লাগছে। কিন্তু কে জানত যে তারই একটাতে উঠতে হবে!

     জন্মাবধি আহ্নিকগতি, বার্ষিকগতির কবলে আছি, বই পড়ে জেনেছি। চলতে ফিরতে ভাগ্যে তার কোনো বোধগম্যি হয় না। কিন্তু এই ট্রেনটির মতিগতি ভয়ানক। এর চলা মানে ঘুরেই যাওয়া, ঘুরেই যাওয়া। একই বাড়ি, একই গাছ, একই মেলার দোকান ঘুরে ঘুরে আসে। আমি আর দেবা ভাবি এই বুঝি ফসকে গিয়ে কারোর ঘাড়ে পড়লাম। যিনি কোলে আছেন, তিনি নিশ্চিন্ত মনে কখনও গান গায়, কখনও তালি দেয়, কখনও খিলখিল করে হেসে ওঠে। মাঝে মাঝে মাথা ঘুরিয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকায়। গালে হাত বোলায়। যেন বলতে চায়, ভয় কি, আমি তো আছি!

     গাড়ি যত ঘোরে মাথা তত ঘোরে। নীচ থেকে দুটো কুকুর মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে। এক সময় মনে হল সারা মেলার লোক বুঝি তাকিয়ে আছে, আমাদের এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখছে।

     যা হোক, ট্রেন থামল। সিঁড়ি বেয়ে নিজেকে সামলে নেমে এলাম। কোলের তিনি আঙুল উঁচু করে আরেকটা নাগরদোলা দেখিয়ে বলল, চোব্বো.... মানে চড়ব।

     চড়ো, নিশ্চিন্তে চড়ো। ওতে পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বে ওঠার নিয়ম নেই। সে বয়েস যে পেরিয়েছি সে নিয়ে কারো সংশয় নেই।

     সে চড়ল। একজন ভদ্রলোক পাশে দাঁড়ালেন। কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, দাদা ফতুর হয়ে গেলাম। রোজ এসে একটাতে না একটাতে চড়ছেই।

     দেখলাম একজন খুদে, ‘মিকিমাউস’ নামক ঢাউস একটা ফোলানো বেলুনের মাথায় চড়ে ধমাস ধমাস করে সোল্লাসে নাচছে। বাবা নীচে দাঁড়িয়ে। হাতে সোয়েটার, টুপি, মোজা আর জুতো। মুখটা করুণ। বললাম, রোজ আসেন?

     রোজ। অফিস থেকে ফিরতে দেরি। সেজেগুজে বসে থাকে। এলেই এক কাপ চা খেয়েই আসতে হয়।

     মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাঁ করে তাকিয়ে বাচ্চাটার দিকে। প্রশ্রয়, করুণা, আদর, অসহায়তা। সব মিলিয়ে কি এক উদাসীনতা চোখে মুখে।

     বাচ্চাটা নাচছে। মাথার উপর মস্ত আকাশ। মেলা ভর্তি লোক। বাচ্চাটা নাচতে নাচতে শুধু একবার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে। বাবা আছে তো জগত আছে।

     এবার বেলুন দাও।

     কই বেলুন?

     ওই যে ঠাম্মা....

     বেলুন দিন।

     বেলুন নিল। বুড়ির মাথা ঢাকা সবুজ আর লাল উলে বোনা মাফলারে। সাদা শাড়িটা মাথায় জড়ানো। গায়ে একটা চাদর। হাতে বেলুনের সম্ভার।

     মেলায় এক কোণে বসে বুড়ি। ছেলে আর নেই। সংসারের ভার আছে, দিয়ে গেছে সে। বেলুন বিক্রি তাই।

     উদাসীন চোখে মেলার আলো দেখে বুড়ি। বেলুন বেচে।

     কে এটা?

     ঠাম্মা....

     বুড়ির চোখে স্নেহ। হেসে বলল, তাই তো.... ঠাম্মা। কোলে নিল। বাচ্চার মা লজ্জা পেয়ে বলল, আপনি...

     ততক্ষণে ঠাম্মার কোলে সে। অভ্যস্ত কোল। কত কেউ মানুষ হয়ে গেল! উষ্ণ কোল।

     বাচ্চার মা বেলুন কিনল। বুড়ি টাকা নিল। মুখে লজ্জা। দুটো টাকা কম। কোলে উঠেছে যে। ভালোবাসা ভীষণ নিশ্চিত অনুভূতি। এলেই টের পাওয়া যায়।

     কানে একটা নতুন দুল পরে ছেঁড়া নাইটি পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে পাগলী। চীৎকার করে বকছে, মেয়েমানুষ হয়ে সিগারেট খায়? ছি ছি... ফেল ফেল....

     কেউ শুনছে না। পাগলির দায়িত্ব পুরো মেলাকে সামলে রাখা। কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে বার করে দেওয়া। কুকুরগুলো তার কথা শোনে।

     ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্চাটা। নীল সোয়েটারে মোড়া শরীরটা মায়ের কাঁধে এলিয়ে দিয়ে মেলায় ঘুরছে। নিশ্চিন্তে।

     গোটা জীবনে এই একটা জিনিসই তো মানুষ আসলে চায়, একটু নিশ্চিন্তি..... মেলাই হোক... কি একলা.... পাবে না? পাবে তো। তাই তো খুঁজছে দুটো চোখ... ভরসা করবে সব ছেড়ে.... আছে আছে... নিশ্চয়ই আছে...