আসলে কেউ বোকা না। কেউ কেউ বোকা সেজে থাকে।
মাথার উপর ফ্যানটা ধীরে ধীরে ঘুরছে। লোকটার বেডের নাম্বার ৩৬। কতদিন হল ভর্তি মনে নেই। ডাক্তার, নার্স কারোর মনে নেই। খাতাটা ইঁদুরে কেটেছে। সেই খাতায় ভর্তির তারিখ, রোগের নাম, জ্বর আসার সময়, রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট – সব লেখা ছিল। ইঁদুরে কেটেছে। কোন জাতের ইঁদুর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজকাল সারা শহরে ইঁদুরের উৎপাত। রুগীকে দেখতে আসা ডাক্তারেরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস কথা বলে। তার পেটের দিকে, পায়ের পাতার দিকে, মাথার দিকে আঙুল দেখায়। স্যালাইনের বোতলে ছোটো ছোটো পোকা ছেড়ে দিচ্ছে। লোকটা আধজাগা হয়ে দেখে। হাস্পাতালের দেওয়াল বাড়িয়ে বাড়িয়ে দুটো ফুটবল ম্যাচের মাঠ হয়ে গেছে। আরো বাড়ানো হবে। আরো রুগী আসছে। আসবেও।
লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। হাস্পাতালের বালিশের মধ্যে মাথা গুঁজে। মাথাটা নাড়ালেই টলটল আওয়াজ। মাথা ভর্তি জল। জোরে শ্বাস নিতে গেলে কুলকুল শব্দ – ফুসফুসে দুই গেলাস জল। হাঁটলে পেটের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ – পেটের মধ্যে জল। লোকটার মনে হয় সে প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় শুয়ে আছে। কিছুদূরে বিষ্ণু ঘুমিয়ে আছে। মহাদেবের অনিদ্রা রোগ। বসে বসে বকবক করে যাচ্ছে। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তার শরীর দুলিয়ে যায়। শামুকের মত পাশ দিয়ে হেঁটে যায় – ইতিহাস। ইতিহাস মানে কল্পনা। শামুকের খোলে ঢাকা তলতলে বদমায়েশি মানুষের। কোনো ইতিহাস নিরপেক্ষ নয় – শামুকের তলতলে দেহের মত ঝুঁকে থাকে কোনোদিকে। শামুকে ঢাকা শক্ত তথ্যের খোলস। মিথ্যা। ছলনা। লোকটা সমুদ্রের তলায় হাঁটে। জলের তলায় সারা শরীর জল নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হয় না।
“ওষুধটা খেয়ে নিন”
একটা গেরুয়া জামা পরা নার্স। কিছুটা দূরে লেনিন আর মার্ক্সের ছবি আঁকা দুটো স্যালাইনের বোতল হাতে আরেকজন নার্স। আরো কত ছাপের স্যালাইনের বোতল ঝোলানো এদিকে সেদিকে।
লোকটা ওষুধ খেয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। দুই হাতে স্যালাইনে ঢুকছে স্লোগানের পোকা। মাথার জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। বুকের জলের মধ্যে ভাসছে শ্লোক। পেটের জলের মধ্যে শুধু ভুড়ভুড়ি – প্রশ্নচিহ্ন। গণতন্ত্র থেকে দুটো শাখা বেরোচ্ছে – এক গরিষ্ঠ, দুই লঘিষ্ঠ। গরিষ্ঠের গায়ে লঘিষ্ঠের বনসাই। দু'বেলা ওষুধ স্প্রে করে যাচ্ছে – শান্তির দূত। তারপর তারা ক্যাফেতে বসেছে সবাই। ভাগ বাটোয়ারা চলছে – শান্তিরসের। যে শান্তিতে প্রশ্নচিহ্নের বাঁকা প্রতীকটাকে কৌশলে সোজা করে দেওয়া হয়, প্রশ্নচিহ্ন হয়ে যায় বিস্ময়বোধক - ? -> !
বিস্মিত মানুষ স্তব গায়। ক্রমশ বিস্ময়চিহ্ন দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দুটোর মানেই হয় যতিচিহ্ন – মানে দাড়ি। ! -> । + .
সব থেমে যায়। শুধু কয়েকটা মানুষের পেটের মধ্যে থেকে শব্দ আসে – ভুড়ভুড়। কেউ বলে স্লোগান, কেউ বলে শ্লোক।
লোকটা একদিন পালালো। সেদিন রাত ছিল পূর্ণিমার। লোকটা হাস্পাতালের বাইরে এসে দাঁড়ালো। সারা শরীর জুড়ে জল টলমল করছে। লোকটার মনে হল সে যেন লুম্বিনীতে আছে। এ যেন তার মহাভিনিষ্ক্রমণ। কতটা রাস্তা হাঁটল লোকটার মনে নেই। একটা রেললাইনের কাছে এসে দাঁড়ালো। ভোর হচ্ছে। সূর্য দেখে চমকে উঠে লোকটা একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। মনে হল সে যেন অজামিল। সূর্যের আলো এসে ঝোপের মধ্যে তার গায়ে জ্বালা ধরালো। চিড়বিড় করতে শুরু করল সারা গা। শরীরের মধ্যে থাকা জল গরম হতে শুরু করল। একটু পর বাষ্প হয়ে যাবে, তাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। লোকটা চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল রেললাইনের ধারে এসে। রোদের জ্বালাপোড়া ভাব ভালো লাগছে এখন। মাথার মধ্যে স্লোগানগুলো ফুটছে। বুকের মধ্যে শ্লোকের পর শ্লোক জোড়া লেগে কি একটা উচ্চারিত হচ্ছে, সে বুঝছে না।
তার মাথার কাছে একটা কাক এসে বসল। বুকের কাছে একটা বক। পেটের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেঁচো। লোকটা চোখ বন্ধ করল। মাথায় পেটে তীক্ষ্ম চঞ্চুর ঠোকরানো অনুভব করছে। নাভির ভিতর গর্ত করছে কেঁচো।
আচমকা তার চোখের পাতা কে যেন টেনে খুলতে চেষ্টা করছে। লোকটা খুলবে না। তবু পারল না। একটা বুড়ো। ঝুঁকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। কে তুমি? কবিরাজ?
বুড়োটা কিছু বলল না। কাক, বক আর কেঁচোকে তাড়িয়ে তাকে সোজা করে বসালো। তাকে বলল –
চোখ বন্ধ করো।
লোকটা চোখ বন্ধ করল। বুড়োটা তার কানের মধ্যে দিয়ে কিছু ঢুকিয়ে দিল। তীব্র জ্বালা, যেন অ্যাসিড। ফলার মত প্রশ্নচিহ্ন মাথায়, বুকে, পেটে ভেসে বেড়াতে শুরু করল। বুড়োটা বলল, চোখ খোলো।
লোকটা চোখ খুলল।
বুড়োটা বলল, প্রশ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রেখো।
লোকটা বলল, তুমি কি ডাক্তার?
বুড়োটা বলল, আমি দার্শনিক।
লোকটা বলল, কি বিশ্বাস করো?
বুড়োটা ভুরু কুঁচকে বলল, যে বিশ্বাস করে সে দার্শনিক কি করে হয়? দার্শনিকের কাজ প্রশ্ন করা... প্রশ্নে বাঁচা...
লোকটা জিজ্ঞাসা করল, প্রশ্ন না করলে কি হয়?
বুড়োটা বলল, পেটে, মাথায়, বুকে জল জমে। শ্যাওলা হয়। পোকা হয়। অবশেষে মানুষ প্যাঁচা হয়।