Skip to main content

সন্ধ্যে হুস করে হয়ে গেল। আসলে মেঘলা। নইলে এই জুলাই মাসে এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়?

 
    ঝন্টি রাস্তার মাঝখানে বসে একটা বিড়ি ধরালো। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে। অনেকদিনের কাজ। রাস্তা চওড়া হচ্ছে। মাঝখানে খুঁড়ে একটা বড় ঢিবি মত করেছে। বাবুদা যা বলছে, তাই করছে। ঝণ্টির লেবারের কাজ। রাণাঘাটে বাড়ি। বাবা নেই। মা নেই। ভাই নেই। বোন নেই। ঠাকুমা ছিল। নেই। সে আকাশ থেকে জন্মেছে। ঠাকুমা ভিক্ষা করত। রাণাঘাট স্টেশানে। মরার সময় ছিল না ঝণ্টি। কেরলে ছিল। বাবাইদা নিয়ে গিয়েছিল কাজে। বিল্ডিং বানানোর ওখানে লেবারের কাজ ছিল। ঠাকুমা মরেছে কেউ জানায়ও নি। কেরলের খাবার সহ্য হচ্ছিল না। খালি খালি বমি পায়খানা। বাবাইদা পাঠিয়ে দিল। রিজার্ভেশন করেনি। জেনারেলে দাঁড়িয়ে বসেই চলে এলো। ভোরে হাওড়ায় যখন ট্রেন ঢুকল শরীর আর দিচ্ছে না। পায়খানা দিয়ে রক্ত পড়ছে। কোনোরকমে বাসে চড়ে শিয়ালদা, তারপর ট্রেন। ট্রেনে তো অজ্ঞানই হয়ে গেল। লোকে বলল গ্যাস। গ্যাস না, খিদে। রাণাঘাটে নামল বেলা ন'টা। দরজায় তালা দেওয়া। কেন? এত সক্কালে মাল বুড়ি ভিক্ষা করতে বেরোল নাকি?

    স্টেশানের দিকে যেতে যাবে, পাশের বাড়ির বউটা এসে বলল, এই ঝন্টি, তোর ঠাকুমা তো মরল।

    ঝন্টির মাথাটা চক্কর খেয়ে গেল। কি করে মরল, কেন মরল, কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করল না। বউটা বলল, ক্লাবের সেক্রেটারি বিষ্ণুদার কাছে চাবি আছে।… চা খাবি?

    ঝন্টি ক্লাবের বাইরে বসেছিল পাক্কা দু’ঘন্টা। বিষ্ণুদা চাবি দিয়ে বলল, তোর তো কোনো নাম্বার ছিল না আমার কাছে.. ঠাকুমা ঘোরের মধ্যে ‘ঝন্টি.. ঝন্টি’ বকে মরছিল….

    ঝন্টি চাবিটা নিয়ে চলে এলো। লোকের সামনে চোখে জল এলে মনে হয় শালা প্যাণ্টে হিসি হয়ে গেছে। পালা ঝন্টি... পালা...।

    ঝন্টি বিড়িটায় আবার টান দিল। ষোলো বছর বয়স হল, কিন্তু গায়ে গত্তি লাগল না। বাবাইদা বলে সারাদিন ওইসব করলে কারোর বডি হয় না। ঝন্টি চায় না। তবু পারেও না। সেদিন দুপুরে, ফাঁকা ঘরে শুয়ে, ঠাকুমার জন্য কাঁদল। তারপরেই ঘুম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যেবেলা। পাশের বাড়ির বউটাকে মনে পড়ল। হলুদ নাইটি। ভাবতে ভাবতে শরীরে সেই মোচড়টা দিল। খানিকবাদেই সব খাল্লাস। শরীর আবার নেতিয়ে। কি করে বডি হবে? এক একদিন চার পাঁচবার হয়ে যায়। ছুটির দিনে বাড়ি থাকলেই বেশি। কাজ না থাকলে আরো।

    ঝন্টি ফোন….

    কুচ্চাদা, মুর্শিদাবাদে বাড়ি। বাজে স্বভাব। রাতে শুলে কাউকে না কাউকে চাই মাল। ছেলেদেরও ছাড়ে না। কুচ্চাদা বাবুদার ডানহাত। কয়েকটা ছেলে আছে, ভাড়া খাটে। একবার সন্ধ্যের সময় লরি করে ফিরছে। রাস্তায় ঝিমুনি লেগে এসেছে। হঠাৎ দেখে তার নুনুতে কার হাত। কুচ্চাদা, তার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এনে, জিভটা বার করে…. ছি…. এক ধাক্কায় সরিয়ে বলেছিল, এসব নোংরামি আমার সঙ্গে করতে আসবা না…

    চাইলে খিস্তি করতে পারত। চড় মারতে পারত। কিন্তু বলেনি। কুচ্চাদাও আর ঘাঁটায়নি। বরং তারপর থেকে একটু সমঝিয়েই চলে। গত মাসে কুচ্চাদার মা মারা গেছে। এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। বেশি ঘাঁটায় না কাউকে। কথা কম বলে। কাঁদে। কষ্ট লাগে।

    তিয়াশা ফোন করেছে। তিয়াশা ফোন করে। সপ্তাহে একবার। ঝন্টি বলেছে পয়সা জমিয়ে সে একটা বড় ফোন কিনবে। কুচ্চাদার ফোনে ফোন করে তিয়াশা। তার তিয়াশা। ভগবান সবার জন্য একটা করে মানুষ বানায়। তার জন্য তিয়াশা। রাণাঘাটে ওর বাবার ফলের দোকান। নাইনে পড়ে। কালো, কিন্তু মুখটা দেখলে ভালো লাগে। জড়াতে ইচ্ছা করে। বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। চুলগুলো নিয়ে খেলা করতে ইচ্ছা করে। নাভির মধ্যে জিভ দিয়ে দুষ্টুমি করতে ইচ্ছা করে। তিয়াশা তার। একার তার।

    ফোনটা নিয়ে রাস্তার একটা ধারে চলে এলো। পশ্চিম দিকে মেঘের গায়ে সূর্যের আলো লেগে মনে হচ্ছে যেন ট্রেন লাইন পাতা আছে। লাইনে আলো লাগলে এরকম ছটা হয়। তিয়াশা কথা বলছে। ঝন্টি খালি পা। রাস্তার পাশে ঘাসের উপর দাঁড়ালো। ভিজে ঘাস। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। পায়ে বৃষ্টির জল লাগলে আরাম লাগে। তিয়াশার ভিজে ঠোঁটে চুমু বুলালো মনে মনে। তিয়াশা কথা বললে বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করে। যতক্ষণ কথা বলে ততক্ষণই করে। মাঝে মাঝে কান্না পায়। মাঝে মাঝে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়। মনে হয় ঠকাচ্ছে সবাই তাকে। তিয়াশাও। খুব চালাক সবাই। সে খালি বোকা। না, সেও চালাক। সেও ঠকাবে। তিয়াশাকে না। তিয়াশা ঠকালে খুন করে দেবে।

    খেয়েছ?

    হ্যাঁ, আজ ডিম ভাত খাইয়েছে... তুই?

    আমি খিচুড়ি খেয়েছি…. আজ যা বৃষ্টি হল এদিকে… তোমাদের ওদিকে….

    হয়েছে... কাজ বন্ধ ছিল….

    রাস্তা বন্ধ?

    একদিক…. কি দারুণ দারুণ সব গাড়ি…

    হুম…. কি পরে আছ?

    হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট…

    সেই নীল আর কালো…

    মনে আছে তোর?

    বাহ রে….

    ঝন্টি….. এই ঝন্টি….

    বাবুদার গলা….

    ঝন্টি ফোন রেখে তাড়াতাড়ি এলো। বাবুদা বলল, চিকেন আর মাল নিয়ে আয়…. কুচ্চার সঙ্গে যা... ওকে সব বলা আছে... আমি আজ বাড়ি ফিরব না….

    ঝন্টির রাগ হল। ভীষণ রাগ। তিয়াশা রাগবে না। ওর রাগ হয় না। ও খালি বলে তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করো। রাস্তায় অত গাড়ি।

    ঝন্টির এক এক সময় মনে হয় ও মরে গেছে। তিয়াশা কাঁদছে। খুব কাঁদছে। মনে মনে জড়িয়ে ধরে আদর করে তিয়াশাকে। চুমু খায়। মড়া মানুষ কি করে জড়িয়ে আদর করবে? চুমু খাবে? তিয়াশা তো ভয়েই মরে যাবে। এই গল্পটা একবার বলতে গিয়েছিল তিয়াশাকে। ভেবেছিল হাসবে খুব। কাঁদল। ঝন্টির খুব লজ্জা লেগেছিল। বোকা লেগেছিল নিজেকে। এতে কাঁদার কি হল? মেয়েরা বোকার মত ভালোবাসে... ইচ্ছা করে, নাকি অমনিই? বুঝতে পারে না।

    কুচ্চাদা বাইক চালাচ্ছে। বাবুদার বাইক। কাঁচরাপাড়া যাচ্ছে। চিকেন আর মদ আনতে। কুচ্চাদাকে ছুঁতে ভালো লাগে না। ঝন্টি বাইকের পিছনের দিকটা ধরে বসল। মেঘের বুক থেকে সূর্যের আলো মুছে গেছে। চারদিক অন্ধকার। তিয়াশা কি করছে এখন?

    ঝন্টি, এ নে... চট করে কথা বলে নে... আমি আসছি…

    কুচ্চাদা ফোনটা দিয়ে গেল। মানে কুচ্চাদা যাবে কোথাও। আধঘন্টা সময়। কোথায় যায় বুঝতে পারে না। ঝন্টি ফোনটা অন করল। শিবের ছবি। কলার লগে প্রথমেই তিয়াশার নাম্বার। বাড়িতে একা থাকে মেয়েটা। মা নেই। গলায় দড়ি দিয়েছিল। ওর কাকারা খারাপ। তিয়াশার বুকে হাত দিত আদর করার ভান করে। একবার এক কাকা জোর করেছিল। তিয়াশা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে নাকি ছেড়ে যায়। সত্যিই কি ছেড়ে গিয়েছিল, নাকি? এই কথাটা মনে পড়লেই রাগ হয়। মাথাটা গরম হয়। বাজে ইচ্ছাগুলো পিঁপড়ের মত সারা শরীরে হেঁটে বেড়ায়। মাথার ভিতরে কামড়ায়।

    রাগটা চড়ে গেল। অকারণে খিস্তি করল কয়েকটা হাওয়ায়। একটা স্ট্যাচু। গান্ধীর। এটা গান্ধীমোড়। প্রচণ্ড ভিড়। যেন কলকাতা। আরো কিছুটা গেলে একটা বড় রেল কারখানা আছে। ঝন্টির মাথাটা গরম হলেই খিদে পায়, ন্যাংটো মেয়েছেলে দেখতে ইচ্ছা করে, ওই সব পাপ কাজ করতে ইচ্ছা করে। একবার করেছিল। দেড়শো টাকা নিয়েছিল মেয়েছেলেটা। পাপ কাজ। তাই তো পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা উপড়ে গিয়েছিল কাজ করার সময়। কি রক্ত! ছুটি নেয়নি তাও। 'পাশ্চিত্য' করেছিল।

    একবার পায়ের দিকে তাকালো ঝন্টি। নখটা এখনও কিরকম। ভালো করে ওঠেনি। কিরকম এবড়োখেবড়ো। রাগটা পড়ে গেল। সে নিজে কি? তিয়াশা ভালো। অনেক ভালো।

    হ্যালো….

    বলো…

    কি করছিলি…

    চা…

    একা খাবি?

    না, মেশো এসেছে..

    রেখে দেব?

    না.. না... আমি রান্নাঘরে, মেশো টিভি দেখছে... খেলা আছে কি একটা…

    ইনি তোকে খুব ভালোবাসেন, না?....

    হুম... তুমি কোথায়? এত আওয়াজ…

    বাজারে…

    ওইসব কিনতে?... মাল খেওনা কিন্তু প্লিজ….

    ন্যাকামি করিস না... রাস্তায় কাজ করতে গেলে এসব করতে হয়... তোর মত লিপস্টিক মেখে সেজেগুজে পান্তাভাত খেয়ে শুয়ে থাকব নাকি? আমি কি হিজড়ে?

    যত্তসব বাজে কথা….

    তুই আমায় আদর করতে দিবি…

    হুম

    সব জায়গায়…

    আবার অসভ্যতা..

    বল না... কোথায়… কোথায়?

    ঝন্টি নিজেকে বুঝতে পারছে। এটা নেশা। এটা খেলা। বাজে খেলা। যতক্ষণ না শরীর থেকে রস বেরিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ মইয়ে চড়ার মত নেশা, তারপর হঠাৎ….. কিন্তু এটা রাস্তা... একবার মাথা নীচু করে দেখল... হ্যাঁ, প্যাণ্টের উপর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে… উঁচু ঢিবি হয়ে আচ্ছে.... থাক… এখন না..,

    আচ্ছা রাখি.. রাতে এরা টাল হলে আমি ফোন করব... দেখব তোকে…. ওরকম... রাজী?

    ভীষণ অসভ্য হচ্ছ তুমি দিন দিন….

    বাইকে করে ফিরছে কুচ্চা আর ঝন্টি। কুচ্চাদার মুখে গন্ধ পেয়েছে ঝন্টি। চোখদুটো লাল। সবুর সয় না, আর কিছুক্ষণ পরতো গিলবিই রে বাবা!

    বাইক এক্সপ্রেসওয়েতে উঠল। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কুচ্চাদা কি একটা বলে যাচ্ছে ফোনে কাকে। খিস্তি করছে। ফোনটা এক হাতে কুচ্চাদার কানের সঙ্গে ধরে আছে ঝন্টি। আরেক হাতে বাইকের পিছনের রডটা। দু’জনেই কাক স্নান করে যাচ্ছে।

    হঠাৎ কি একটা হল। একটা লরি কোথা থেকে উল্টোদিক থেকে ফুল স্পিডে তাদের সামনে চলে এলো। কুচ্চাদাকে কিছু বলার আগেই ঝন্টি দেখল সে ছিটকে যাচ্ছে পাশের ঝোপের দিকে।

    এক্সপ্রেসওয়ের পাশে একটা ডোবা। জল ছিল না, ঝোপ, আর বৃষ্টি ভেজা নরম মাটি। ঝন্টি মুখ থুবড়ে পড়ল। কিছুক্ষণ খুব গা গুলালো। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। পা দুটো কাঁপছে। আশ্চর্য, হাতে ফোনটা শক্ত করে ধরা। একবার চাপ দিল, স্ক্রিনে একটা চিড় ধরেছে শুধু শিবের মাথার কাছটায়।

    প্রচণ্ড ভয় করছে। আস্তে আস্তে রাস্তায় উঠল মাটি খামচে। বাইকটা একদিকে রাস্তায় শোয়ানো। রাস্তার মাঝখানে শুয়ে কুচ্চাদা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা বৃষ্টির জলে মিশে। মাথাটা থেঁতলে।

    ঝন্টি বসে পড়ল মাটিতে। তারপর কি মনে হল ফোনটা সুইচ অফ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিল। ঝমঝম করে বৃষ্টি তাকে ধুইয়ে দিচ্ছে। ফোনটা খারাপ না হয়ে যায়।