Skip to main content

নাম মানে দিশা। এই যেমন যে হরিদ্বারে যাবে বলে ট্রেনে উঠল, সে ট্রেনে খায়-দায়, গল্প করে, এদিক-ওদিক দেখে কিন্তু তাও সে জানে, প্রতি মুহূর্তে জানে সে যাচ্ছে হরিদ্বারে। তেমনই নাম। নাম মানে দিশা।

দূরের থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে। আজ সপ্তমী। গঙ্গার ধারে কাশের বন ফুলেফেঁপে উঠেছে। যেন সাদা চাদর পেতে রেখেছে কেউ। নৌকা পারাপার করছে।

গোঁসাই জলে নেমেছে ঘট ভরতে। সন্ধ্যে হব হব। সূর্য ডুবছে। আলো থেকে অন্ধকারের দিকে বাইরের প্রকৃতি যখন যায়, মানুষের ভিতরের প্রকৃতিতেও তার ছায়া পড়ে।

আশ্রমে এই সময়টা লোক কম আসে। গোঁসাই মন্দিরে ঢুকল। আমায় বলল, তুমি খানিক বেড়িয়ে এসো। আমি ক'টা কাজ সেরে নিই।

আমি গঙ্গার ধার ধরে হাঁটছি। কোথাও যাওয়ার নেই। কিছুক্ষণ মানে কতক্ষণ গোঁসাই? হাঁটি। নিশ্চয়ই মন-ই বলে দেবে। মনের নিজের একটা ঘড়ি থাকে, নিজের তুলাযন্ত্র থাকে। নির্ভুল নয় যদিও। তবু একেবারে অচলও নয়।

বটগাছের নীচে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বসে। কি নিয়ে একটা বেশ গম্ভীর আলোচনা হচ্ছে। স্ট্রীটলাইটের আলোয় যতটুকু বোঝা যাচ্ছে সবার মুখই বেশ গম্ভীর।

"আরে নিজের চোখে দেখেছি। পদা, অফিস থেকে এসে স্নানধান করে যেমন রোজ ফোন নিয়ে এ রাস্তায় হাঁটে তেমনই হাঁটছে। আমি গরম লাগছে বলে বাইরে এসে… ওই ঢিবিটার উপর বসে গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে বিড়ি টানছি। বেশি খাওয়া হয়ে গেছে তাই পেটটা আঁইঢাঁই করছে। পদা বলল, কি জ্যাঠা ঘুম আসছে না…..

আমি বললাম, না রে…..

সে উত্তরটা না শুনেই হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখি গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে ছুটে আসছে….. আমার কাছে এসে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়ল…. বলল, জ্যাঠা…. ভূত… ভূত….. কাকলিদি…. গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে….

কাকলির নামটা শুনে আমার হাড় হিম হয়ে গেল। দড়ি কেটে তো আমিই নামিয়েছিলাম। মনে আছে তোমাদের নিশ্চয়ই…..

আমি বললাম, চল তোকে ঘরে দিয়ে আসি… ওকে ঘরে দিয়ে আমি আবার এখানে এসে বসলাম। পৈতেটা ভালো করে পেঁচিয়ে আঙুলে জপ কর‍তে লাগলাম… ভয় কই? হ্যাঁ…. ভয় কই?"

======

গোঁসাই, এও তো নাম করা। ভয়ের থেকে বেরোনোর জন্য। একি দিশা দেয়?

গোঁসাই বলল, দিশা সেকি চায়? সে তো চায় তাৎক্ষণিক একটা ফল। ভয়ের থেকে দূরে যাবে বলে। ভয় একটা বিকার।

বললাম, তবে তুমি ভূতে বিশ্বাস করো না?

আমার বিশ্বাসের উপর যে জিনিস আছে সেকি খুব কাজের বস্তু রে?

তোমার ঈশ্বর তোমার বিশ্বাসের বস্তু না?

ভূতে বিশ্বাস আর গোবিন্দে বিশ্বাস এক? ভূতে বিশ্বাস না, ও ভয়ের বিকার। যা মানুষের ভয় তৈরি করে সে বিকার। দেখো, মানুষের মন কল্পনাশূন্য হয় না। কল্পনায় যদি ভয়, হিংসা, লোভের ইন্ধন লাগে তবে সে বিকার জাগায়। আর যদি ভালোবাসার ইন্ধনে জ্বলে তবে সে প্রিয়তমকে সৃষ্টি করে। সে যাকে ভালোবাসে সে বিশেষ হয়ে ওঠে। সে যেভাবে তাকে দেখে আর পাঁচজন তাকে সেভাবে দেখে কই? কারণ সে তার নিজের সৃষ্টি। তার ভালোবাসার সৃষ্টি।

তোমার গোবিন্দ?

আমার গোবিন্দও আমার শূন্যতার কল্পনায় অনন্তের মাধুকরী। সে একদিকে অনন্ত, আরেকদিকে শূন্য। একদিকে নিরাকার, আরেকদিকে সাকার। একদিকে নশ্বর, আরেকদিকে অবিনশ্বর। যে যাকে ভালোবাসে তাকেও সে গোবিন্দের রঙেই দেখে। সে একই সঙ্গে সাকার, নিরাকার। ধরা - অধরা। ভালোবাসা যত পাকা হয় এ পরিচয় তত নিবিড় হয়। অসীমের আসন পাতা হয় সসীমের বুকে। মাধুর্যের মাধুকরী হয়ে আসে সে।

======

মণ্ডপে আরতি চলছে। আমার টোটো ধীরগতিতে চলছে ভিড় ঠেলে স্টেশানের দিকে। এই যে এত এত মানুষ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে…. এই যে ঢাকের আওয়াজ, কাঁসরের আওয়াজ, শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনি… এসবে মিশে যে ছবি আঁকা হচ্ছে সে কি?

মন, তোমার কল্পনায় কার ইন্ধন? লোভের, না ভালোবাসার? তোমার চিত্তপটে কিসের চিত্র? বিকারের, না সুন্দরের…..

"কি সুন্দর সাজিয়েছে না দাদা? মনটা একদিন কি আনন্দে যে ভরে থাকে….. মা চলে গেলেই সবটা ফাঁকা…. এই তো আপনাকে নামিয়েই মেয়েটাকে নিয়ে বেরোবো…. সেজে বসে আছে…"

আমি বললাম, আজ আর বেরোবে না?

টোটোওয়ালা হাসল। বলল, সে যদি বেরোতে দেয় তো…..