Skip to main content

হয় তো হেঁটে মরুভূমি পেরোনো যায়। হয় তো এক মহাকাশ সাঁতরে পার হয়ে চলে যাওয়া যায় আরেক মহাকাশ। কিন্তু এই এত মানুষের ভিড়, আমাকে পরোয়া না করা ভিড়? এর মধ্যে আমিও তো হেঁটেছি একদিন।

এখন আর কোনো কাজ নেই। সকালের আলো ধীরে ধীরে দুপুরের আলো হয় কি করে বারান্দায় বসে বসে দেখে। তারপর দুপুরের আলো কি করে করে বিকেলের আলো হয়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখে। বিকেলের আলোয় ভিজে মেঝে যেমন করে শুকিয়ে যায় অলক্ষ্যে, তেমনই অন্ধকার হয়ে আসে। কোনো কোনো বাড়ি সন্ধ্যে দেওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। লক্ষ্মী দেখে তার বাড়ির সামনে দিয়ে দেবতারা হেঁটে হেঁটে, আকাশের অন্ধকার থেকে রথে নেমে এর ওর বাড়ি যাচ্ছে। লক্ষ্মী প্রদীপ জ্বালায় না। যেটুকু আছে সেটুকু সঞ্চয় করে রাখে।

======

একদিন ঝড় উঠল। বিকেলে। কালবৈশাখী। লক্ষ্মী বিছানায় শুয়ে। ধুম জ্বর তার। আজই ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে হেলথ্ সেন্টারে গিয়ে। ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু বমি হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে চাপ ধরে আছে। মাথাটা টলছে। গা গুলাচ্ছে। বাইরে ঝড় হচ্ছে। কেউ তার পরোয়া করে না।

লক্ষ্মী চোখটা বন্ধ করে নারায়ণকে ডাকল। নারায়ণ এলো না। গরুড় এলো। মাথার কাছে বসে বলল, নারকেল কোরা আছে? খিদে পেয়েছে।

লক্ষ্মীর তেষ্টায় ঠোঁট, জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। সে বলতে গেল। পারল না। জানলার উপর বসে তার পাখা দুটো মেলে বলল, বাহ্, কি হাওয়া!

লক্ষ্মী বলল, আমায় নিয়ে যাও। নারায়ণের কাছে নয়, আমার স্বামীর কাছে।

গরুড় বলল, হবে না, ও বাড়ির বুড়ি অনেক তীর্থে গেছে। চারবার তিরুপতি, দশবার পুরী, একবার কেদার। ওকে নিয়ে যাব।

======

লক্ষ্মী কোনোদিন তার গ্রামের বাইরে যায়নি। লক্ষ্মীর ঘুম থেকে উঠে মশারির বাইরে আসলেই মনে হত অন্য জগতে নামছে। মেঘাম্বর তখন জোরে জোরে মন্ত্র পড়ে পুজো করছে। লক্ষ্মী খাটে বসে বসে তার কোমরে ধুতি জড়ানো কালো স্থূল শরীরটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। হাতজোড় করে মেঘাম্বরকেই প্রণাম করে। ভালোমন্দ যা কিছু সংসারে জানে সব মেঘাম্বরকে জড়িয়েই তো জানে। বিয়ে হয়েছে তেরো বছর বয়সে। তবে? আর কোনো পুরুষকে জানে নাকি? মেঘাম্বর আদর করলে মনে হয় কৃষ্ণের বাঁশি। মেঘাম্বর চড় মারলে মনে হয় রুদ্র। মেঘাম্বর সেজেগুজে কোনো কাজে বা অনুষ্ঠানে গেলে মনে হয় কার্তিক। সবই মেঘাম্বরকে নিয়েই লক্ষ্মীর।

লক্ষ্মী মাটিতে পা রাখে। রান্নাঘরে যায়। জানলা খোলে। পুকুরে সূর্যের ছায়াটা দেখে। হাঁসগুলোকে দেখে। রান্নাঘরে আকাশের আলো এসে তাকে, চুল্লীতে বসে। লক্ষ্মী চা বসায়।

======

এখন সকালে রান্নাঘর খোলে না লক্ষ্মী। আকাশের আলোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। মেঘাম্বর যতদিন ছিল ততদিন মনে হত তাদের বাড়ির উপরের আকাশটা তাদেরই। এখন মনে হয় গোটা শরীরটা আত্মাকে নিয়ে মাটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেকে সাপের মত লাগে লক্ষ্মীর। বিষহীন সাপ।

======

স্কুলের ক্লার্ক ছিল মেঘাম্বর। সেদিন সকাল থেকেই ঘামছিল। এমনকি তার টেবিলে মাথাটা রেখে যখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তখনও হিসাবের খাতা মেঘাম্বরের ঘামে ভিজে গিয়েছিল। সবাই বলাবলি করছিল। মেঘাম্বরকে নতুন ধুতি-চাদর গায়ে দিতে দেখে স্কুলের স্যারেরা নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করছিল। ম্যাডামরা তার ঘরের মাচার উপর লাউ দেখছিল, বাগানের কুমড়ো, শসা দেখছিল, পেয়ারাগুলো গাছ থেকে পেড়ে কেউ কেউ আঁচলে, ব্যাগে ভরে নিচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছিল। সেদিন থেকেই অল্প অল্প করে সাপ হয়ে যাচ্ছিল লক্ষ্মী। তার হাত-পা সব ধীরে ধীরে সাপের মত খসখসে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এখন তো সে পুরোপুরি সাপ।

======

লক্ষ্মী ছেলেবেলায় ঝিনুক জমাতো। তাদের বাড়ির কাছেই ছিল সমুদ্র। তার বাড়িতে সারাদিন মাছের গন্ধ। স্কুলের সব বন্ধুরা আসত না তাই। তার বাবা মাছ ধরতে যেত। লক্ষ্মী মায়ের কোলে চড়ে বাবার নৌকা মিলিয়ে যেতে দেখত কখনও কালো মেঘে, কখনও নীল মেঘে। প্রতিবার মা ধীরে ধীরে মন্ত্র পড়ত। লক্ষ্মী নোনা হাওয়ায় চোখ বন্ধ করে ঠাকুরের কাছে বলত, আমিও যাব…. বাবার সঙ্গে আমিও যাব।

======

বেশিদিন স্কুলে যায়নি লক্ষ্মী। বাবা জলে হারিয়ে গেল। পাওয়া গেল না আর। মা তার বিয়ে দিয়ে দিল পরের বছরেই। মেঘাম্বরের বয়েস তখন ছাব্বিশ। তার তেরো। মেঘাম্বর স্কুলে ঘন্টা বাজাত। পড়াশোনাও করত। লক্ষ্মীকে দেখতে ভালো ছিল, পাড়ার সবাই বলত। তখন লক্ষ্মী নিজেকে মৎসকন্যা ভাবত। পূর্ণিমার দিন রাতে মায়ের সঙ্গে সমুদ্রের ধারে হাঁটতে হাঁটতে ভাবত সমুদ্রের তলায় তার আসল দেশ। আসলে সে খুব সুন্দর মাছ একটা। একজন খুব সুন্দর দেখতে পুরুষের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। সে একদিন এই জলের থেকে বেরিয়ে এসেই তাকে কোলে নিয়ে আবার জলে চলে যাবে।

লক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছিল পূর্ণিমাতেই। যখন রাত্রিবেলা তাকে গাড়িতে করে নিয়ে মেঘাম্বর আসছিল তার মনে হচ্ছিল রাবণ তাকে নিয়ে যাচ্ছে। সে বড় বড় চোখ করে সমুদ্রের জলের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল একজন রাজপুত্রের। যার জলের নীচে রাজত্ব। যে তাকে রাণী করে নিয়ে যাবে।

সমুদ্র কথা রাখেনি। মা-ও না। মা তার বিয়ের ক'দিন পর ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। লোকে খারাপ খারাপ কথা বলে মা'কে নিয়ে। লক্ষ্মী মনে রাখে না। কষ্ট পায়। ভাবে মা হয় তো মারা গেছে। তবু শহরের বাস তার বাড়ির সামনে দাঁড়ালে লক্ষ্মী ভয় পায়। যদি মা অনেক গয়না পরে নামে? যদি তার হাত ধরে বলে, চল…. মেঘাম্বর বাঁচাবে তাকে?

ধীরে ধীরে ভয় কেটে গেল। তারপর আর বাসের আওয়াজ পেলেও বাইরে এসে দাঁড়াত না লক্ষ্মী।

======

মাছ নয়। এখন সরীসৃপ। লক্ষ্মীর বাচ্চা নেই। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে। মেঘাম্বরের দোষ ছিল। তার শরীর থেকে যা আসত, সেগুলো দুর্বল। ডাক্তার বলেছিল। কিন্তু এত শক্ত শরীরে অত দুর্বল কিছু থাকে কি করে? তার পাশের বাড়ির গণেশের যেদিন ছেলে হল, অবাক হয়ে লক্ষ্মী গণেশকে দেখেছিল। দুটো সরু কাঠির মত হাত-পা। এই দুর্বল শরীরে অত শক্তিশালী রস থাকে কি করে? অনেক অনেক জড়িবুটি খেয়েছে মেঘাম্বর। দু'বার চেন্নাইতে এক তান্ত্রিকের কাছেও গেছে। কি একটা খেয়ে রাতদিন ঝিমাতো মেঘাম্বর। নেশাখোরের মত পড়ে থাকত। সেই সুযোগে সেই তান্ত্রিক তার ঘরে ঢুকেছে। জোর করে তার শরীরে ঢুকেছে। লক্ষ্মী চুপ করে থেকেছে। মায়ের কথা ভেবেছে। সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া বাবার কথা ভেবেছে।

ফিরে এসে মাস চারেক ভয়ে ভয়ে ছিল। যদি শরীর খারাপ দু'দিন দেরি করে হয়েছে, বারবার উঠে গিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে পেট টিপে টিপে দেখেছে।

কিচ্ছু হয়নি। তার মানে তান্ত্রিকেরও রস দুর্বল।

======

লক্ষ্মী মারা যাওয়ার দু'দিন পর পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ঢুকেছে যখন, লক্ষ্মী উলঙ্গ হয়ে শুয়ে।

লক্ষ্মী শেষের দিকে বাড়িতে কাপড় চোপড় কিছু পরত না। বারবার নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ত। মনে হত সমুদ্রের জল বেরোবে। মনে হত বাবার মড়া মুখটা দেখতে পাবে। ভেসে উঠবে। মনে হত একটা বড় গর্ত করে শুয়ে থাকতে থাকতে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। খাওয়া দাওয়াও ছেড়েই দিয়েছিল। ডাক্তার বলল, অপুষ্টিতে মারা গেছে।

মাটিতে একটা সাপ, একটা বিছে আঁকা ছিল। লক্ষ্মী মাটিতে আঁকতে আঁকতে গান গাইত। বাচ্চা ঘুম পাড়ানোর গান।

======

লক্ষ্মী বিছানার চাদরে ফুল আঁকত। ফুলের উপর মাছ আঁকত। জলপরী আঁকত। একজন পুরুষ নৌকা করে দাঁড় বাইছে আঁকত।

মেঘাম্বর সেই চাদর বাজারে নিয়ে যেত। শহরের বাজারে। বলত, ভালো দাম দেয় ওরা। খুব চাহিদা। কত দাম দেয় লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করেনি কোনোদিন। ভয়ে।

একবার ডাক্তার দেখাতে যখন শহরে গেল, বাস থেমে নামতে কি উৎকণ্ঠা লাগছিল। তার মনে হয়েছিল এখানে বাড়ি বাড়ি তার চাদর পাতা থাকবে বিছানায়। রাস্তায় যেতে যেতে উঁকি দিয়ে দিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি দেখেছে। যত এগিয়েছে মন খারাপ হয়েছে। একটা বাড়িতেও তার চাদর নেই। মেঘাম্বর ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়েছে। তারা হোটেলে খেতে ঢুকেছে। লক্ষ্মী নিরামিষ খায় বাইরে। মেঘাম্বর মুরগীর হাড় চিবাচ্ছে। লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করেছে, খুব ধীরে, তুমি কি এই বাজারে বিক্রি করেছ চাদর?

======

লক্ষ্মী একটা চাদর লুকিয়ে রেখেছিল। মেঘাম্বরের ট্রাঙ্কের একদম তলায়। মেঘাম্বর নিজের জিনিস খুব একটা নাড়াচাড়া করত না। কোনোদিন পায়নি।

লক্ষ্মীর বাড়িতে যখন পাড়ার লোক, ক্লাবের লোকে ভিড় করল, তখন মেঘাম্বরের ট্রাঙ্কের থেকে চারটে পোকায় কাটা ধুতি আর দুটো পোকায় কাটা পাঞ্জাবির নীচ থেকে সবাই চাদরটা পেল। আশ্চর্য, সেটা পোকায় কাটেনি। কিন্তু যেই না সেটা তুলতে গেছে অমনি ট্রাঙ্কের নীচ থেকে ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে সব দূরে সরে গেল। বিষাক্ত সাপ।

লক্ষ্মী ছাড়া কেউ জানত না, মেঘাম্বর সাপ হয়ে তাকে পাহারা দিত। বিষধর সাপ।

চাদরটা কেউ নেয়নি। নিতে পারেনি।

কথিত আছে এই যে, যে কেউ নেওয়ার চেষ্টা করেছে সে-ই কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

এখন শনি-মঙ্গলবার প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। লক্ষ্মী-মেঘাম্বর আর একা থাকার সুযোগ পায় না এখন। কেউ কেউ বলে সারারাত 'ফোঁস ফোঁস', 'হিস হিস' শব্দ শোনা যায় বাড়ি থেকে। কেউ বলে, কান্নার মত। কেউ বলে, অভিশাপের মত। কেউ বলে, স্তবের মত। কেউ বলে, মন্ত্রের মত।