Skip to main content
দীঘির পাড়ে যে বড় বটগাছটা তার একটা ডালে শুয়ে আছে ভরত। ব্রহ্মদৈত্য। মধ্য আকাশে চাঁদ। বসন্তের বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। একটা পেঁচা ডেকেই চলেছে... আউ... আউ... আউ। তার ডাকের তালে তালে পা দোলাচ্ছে ভরত। তার মনটা আজ ভালো আছে, আবার ভালো নেইও। ভালো কেন আছে জানে... এমন মধুর শান্ত পরিবেশ হলেই ভরতের প্রাণটা শীতল হয়ে যায়। কিন্তু মনটা খারাপ কেন সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
ভরত একটা পাশ ফিরে শুলো। দীঘির দিকে মুখ করে। আহা! কি দৃশ্য! দীঘির জলে চাঁদের ছায়া, আর তাতে মাছের দলের খেলা। হঠাৎ একটা ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ শুনে তাকালো। বাঁশবনের ঝাড় ঠেঙিয়ে এত রাতে কে? মামদো নাকি? না তো, সে তো আজই শ্বশুরবাড়ি গেল সাঁকরাইল, সে এই বটকেষ্টপুর আসবে কোত্থেকে এখন?
আরে এ যে মানুষ! পরেশ। বড় দারোগার ছোটো ছেলে। সে এত রাতে কেন? কোনো নেশাভাঙ করে বলে তো শুনিনি, তবে? ভরত একটা দমকা হাওয়া হয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলো। পরেশ দীঘির ধারে এসে বসেছে। পরেশের বয়েস কত হবে, এই সাতাশ কি আটাশ। কলকাতায় চাকরি। পরেশের মুখ ভার। একটা হাওয়া হয়ে কিছুক্ষণ ওর পাশে বসে রইল ভরত, তারপর আবার গাছটায় এসে শুলো। আজ তার নিজেরই মন ভালো নেই, তা আবার অন্যের মনের খবর। কি একটা আবেশে তার চোখটা সবে জুড়িয়ে এসেছে, এমন সময় একটা কান্নার আওয়াজ শুনে চমকে তাকালো। আরে একি!
পরেশ একটা দড়ি তারই বট গাছটার সাথে ঝুলিয়েছে। এরপরেরটা কি হবে সব জানে ভরত। ভরত একটানে দড়ি খুলে নীচে ফেলে দিল। পরেশ ঘাবড়ে গিয়ে যেই আবার দড়িটা আনতে এগিয়েছে, অমনি সে ফুঁ দিয়ে সেটাকে দীঘির জলে দিল ফেলে। পরেশ হতভম্ব হয়ে দীঘির জলের দিকে তাকিয়ে। 
ভরত একটা টোকা দিল পরেশের মাথায়। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, "কাপুরুষ!" পরেশ এদিক ওদিক 'হাঁ' করে চেয়ে বলল, "তুমি কি সেই ভরতকাকা, যার কথা ঠাকুরদা বলতেন?" ভরত আবার তার কানের কাছে গিয়ে বলল, "হুম।"
পরেশ বলল, "দেখো আমার এখন ভয় পাওয়ার বা রসিকতা করার কোনোটারই ইচ্ছা নেই। কি চাও তুমি?"
ভরতের মেজাজটা গেল বিগড়ে। মারল একটা জোর লাথি পরেশের পিছনে। পরেশ হুমড়ি খেয়ে পড়েই 'হাঁউমাঁউ' করে কেঁদে ফেলল। তার জোর কান্নার আওয়াজ শুনে বরোদা পেত্নী আমলকী গাছ থেকে উঁকি মেরে বলল, "কি হয়েছে রে ভরত?"
বরোদা পেত্নী এই সময়টা একটু আফিম খেয়ে ঘুমায়। ওর সাথে এখন কথা বলা মানে সময় নষ্ট করা। ভরত বলল, "কিছু না পিসী, ওই একটু নাক ঝাড়লাম।" বরোদা বলল, "এই ওয়েদার চেঞ্জের সময় বাবা, একটু সাবধানে থাক।" পিসী আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
পরেশ এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে মাটিতে চিতিয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ভরত এবার নিজের চেহারাতেই তার পাশে এসে বসল। পরেশকে বলল অস্বস্তি হলে সে যেন চোখ বন্ধ করেই রাখতে পারে। সাথে এও বলল, আত্মহত্যা করার চেষ্টা আবার করলে হাড়গোড় ভেঙে বাড়িতে ফেলে রেখে আসবে। এমনিতেই ভুতের সংখ্যা ভীষণ বেড়ে যাচ্ছে, এত লোক আত্মহত্যা করছে, দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে... তার ওপর থাকার জায়গাও পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত।
পরেশের সমস্যার কথা বোঝা গেল। তার একটা বুলেট বাইক চাই। বাবা স্কুটি কিনে দিতে চান, যাতে সবাই চালাতে পারে। পরেশের ধারণা স্কুটি চালানোর চেয়ে আত্মহত্যা করা অনেক সম্মানের। তাছাড়া কাকলীকে মুখই বা দেখাবে কি করে? কাকলী মানে পরেশের প্রেমিকা, জনাই হাবিলদারের মেয়ে, সে মেয়ে নিজেই এনফিল্ড চালায়। এই বটকেষ্টপুরে কাকলীর জিম সবাই এক ডাকে চেনে। ওই জিম করতে গিয়েই তো কাকলীর সাথে প্রেম!
এই কথা শোনার পর বগলাদেবী, মানে বড় দারোগার স্ত্রী, পরেশের মা প্রতিদিন পঞ্চাশটা করে ডন দেন বাথরুমে স্নান করতে যাওয়ার সময়। এ ওই বরোদা পেত্নীই জানিয়েছে ভরতকে। বরোদা পেত্নী হলে কি হবে, খুব দামী সাবান আর দামী শ্যাম্পু মাখার শখ। সে ওই বগলাদেবীর ডন মারা দেখে এসেছিল বাথরুমে ঢুকে।
যা হোক। পরেশকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা বৃথা দেখে ভরত উঠতে যাবে, এমন সময় তার মনে পড়ল, "হ্যাঁ রে তোর কাছে পাঁচু পঁচিশ হাজার পাবে না?" পাঁচু হল পাড়ার সব চাইতে বড় মুদি নিমাই-এর একমাত্র ছেলে। পরেশ থতমত খেয়ে বলল, "হ্যাঁ কিন্তু তুমি জানলে কি করে?"
ভরত আবার বসে পড়ল, "আমি আবার জানব কি করে... পাঁচুর ঠাকুর্দা তো পাশের বাঁশঝাড়েই থাকে। এখন অবিশ্যি নেই। কাশী গেছে, ওনার পিণ্ডিটা স্যাংশান হয়েছে কি না দেখতে। যা লাইন আজকাল। আর বলিস না। গত বছর মহালয়ার দিন নিমাই গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে এলো, তা কি না এখনও টেবিলে পড়ে! ভাবা যায়? আমাদের সময় পিণ্ডি পড়ত আর মঞ্জুর হয়ে যেত। সে যাক, টাকাটা নিয়েছিলি তো কাকলীকে নানচাকু কিনে দেওয়ার জন্য... তাই তো?"
পরেশ বলল, "শুধু নান না... আরো..."
"সে না হয় হল। তারপর? টাকাটা ফেরৎ দিচ্ছিস না কেন? তোর মা তো তোর বাবার উপরি থেকে টাকা সরিয়ে তোকে দিয়ে দিয়েছে..."
পরেশ আবার অবাক, "এও জানো?"
ভরত বলল, "না জানার কি আছে। তোর মায়ের মা... নিত্যকালীর বান্ধবী তো এই বরোদা। সে প্রত্যেক বছর বরোদার সাথে কেঁদুলী যায় গান শুনতে। তা শালারা নাকি এত জোর জোর মাইক লাগিয়ে গান গাইছে আজকাল যে বরোদার কানে এমন তালা লেগে গিয়েছিল যে পনেরো দিন সে কারোর কথাই শুনতে পায়নি। সেই তো বলেছে। কান সারার পর। তোদের বাড়ির উত্তর দিকের বেলগাছে তোর দিদিমা থাকে মাঝে মাঝে।"
পরেশ 'হাঁ' করে শুনছে কথাগুলো। তারপর বলল, "হ্যাঁ কালই দিয়ে দেব টাকাটা। কিন্তু আমার বাইকের কি হবে? ওর বাইকের পিছনে বসে বেড়াতে যেতে লজ্জা লাগে আমার... আর ও চালাতেও দেয় না একটুও..."
ভরত বলল, "ঠিক আছে। আমি কাকলীকে বুঝিয়ে বলব, তোকে ক'দিন চালাতে দেবে... আর তুই চালাবি ও বসবে... হল তো?"
পরেশ বলল, "সে না হয় হল, কিন্তু তুমি বোঝাবে কি করে?"
ভরত হাসল। বলল, "আরে ওই যে বরোদা... ও রমাকান্ত তান্ত্রিককে চেনে। সে না হয় আমাদের মধ্যে একটা মধ্যস্থতা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দেবে।" 
পরেশ চলে যাওয়ার পর ভরত আবার এসে গাছটায় শুলো। মনটা উদাস হয়ে গেছে। পৃথিবীটা খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে কেমন। সে তার গ্রামটার দিকে তাকালো। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির একটা না একটা কেচ্ছা সে জানে। সব ওই বরোদা খবর নিয়ে আসে। বেশির ভাগই খারাপ খবর। আগে বরোদা এমন ছিল না। একদিন রাত্রে ভরত দেখে বরোদা ওর তিন বছরের নাতনিটার সাথে খেলছে। সেই রাত্রেই ভেদবমি হয়ে মারা গিয়েছে। দু'দিন পরে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। বরোদা আফিম ধরল সেই। সে এখন স্বর্গেও যেতে চায় না, আবার জন্মাতেও চায় না। সে বলে স্বর্গেও নাকি এখন বড় গোলমাল। কিন্তু সেখানে কারোর উপর কারো মায়া পড়ে না বলে সবাই সে গোলমালটাও বুঝে উঠতে পারে না। পৃথিবীটার উপর তার বড়ো মায়া।
ভরতের বরোদার জন্য প্রাণটা কেঁদে উঠল হঠাৎ। বড় দুঃখী মানুষটা... থুড়ী পেত্নীটা। বরোদার পাশে বসতেই, বরোদা উঠে বসে পড়ল। বলল, "যাব ভরত তান্ত্রিকের কাছে। কি জানো ভরত... আমাদের পৃথিবীটায় জীবনের থেকে জড় পদার্থগুলো বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছে। আগেও ছিল, পাথরের জড় দেবতা বানিয়ে তাকে বেশি শক্তিশালী ভেবে মরতাম আমরা। কিন্তু এখন দেখো এরা ওই রাতদিন জড় পদার্থগুলো নিয়ে পড়েছে... আসলে চামড়া আছে তো তাই মর্ম বুঝছে না... চামড়ার হাতে চামড়ার হাত লাগলে যে কি সুখ!"
হঠাৎ নিমাইয়ের ঠাকুর্দা এসে বসল ওদের পাশে। ভরত বলল, "কি মশায় পিণ্ডি মঞ্জুর হল?" নিমাইয়ের ঠাকুর্দা হরিসাধন ধরা গলায় বলল, "হয়েছিল ভরত... তবে আমায় যেই জিজ্ঞাসা করল কবে যেতে চাও... আমি ফস্ করে বলে বসলুম... যেতে চাই না তো! অথচ দেখো আমি জানতুম আমি কি ভীষণ যেতে চাই... কি মায়া বলো দেখি... আসলে কি জানো ভরত... মায়ার দুঃখ থেকে শতগুণ কষ্ট মায়া না থাকার দুঃখ... আমি সারাটা পথ ভাবছিলুম তবে কি ভুল করলাম ঝোঁকের মাথায় না করে দিয়ে... বরোদার দিকে তাকিয়ে ভুল ভাঙল... স্বর্গে গিয়ে কাজ নেই ভায়া... দেখি যদি আবার মাটির কাছাকাছি জন্মাতে পারি... আরেকবার মায়ায় পড়ে কাঁদিই না হয়... সেও ভালো... কান্না ভুলে থাকার চেয়ে।"
ভরত আবার এসে গাছটায় শুলো। ভোর হয়েছে। পুবাকাশ লাল হচ্ছে। পাখিগুলো বাসা ছেড়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। আবার ফিরবে ওরা। ফিরবে বলেই তো যাওয়া। ভরতের ভালো লাগতে লাগল। সে কোথাও যাচ্ছে না আর। বরোদা এসে বলল, "যাই কাকলীদের বাড়ি... ওর মতিগতি বুঝি আর ওর মায়ের ফেস পাওডারটাও মেখে আসি। অনেকদিন যাই নি।" হরিসাধন বলল, "আমিও যাই... স্কুল বাড়িটার দিকে... ওখান থেকেই পাল্টাতে হবে বুঝলে... মাষ্টারগুলোকে গাঁট্টা মারা অভ্যাস করি বেচাল দেখলেই..."
ভরতের মনে হল তারও কিছু একটা করা দরকার। কি করবে? ঠিক করল পুরোহিতগুলোকে গাঁট্টা মারা দিয়ে শুরু করতে পারে... যেই না ঠকাতে যাবে...