সমস্যাটা শুরু হল ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ছেলেটা ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, মেয়েটা সেভেনে। কিছুতেই গ্রামের বাড়ি যেতে চায় না। গ্রাম থেকে কেউ এলে, ভালো করে কথা বলে না। এড়িয়ে এড়িয়ে যায়। বন্ধুদের বাড়ি আসতে বলে না এই সময়টায়।
কষ্ট পায় দু'জনেই, যারা আগে শুধু স্বামী-স্ত্রী ছিল, এখন বাবা-মা হয়েছে।
=====
অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে দু'জনে। সুকান্ত হেমব্রম রেলে কাজ করে। মঞ্জরী হাসপাতালে। রেলের কোয়াটার্সে থাকে। ছেলে আশীষ, মেয়ে রচনা।
মঞ্জরী আর সুকান্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করে। মঞ্জরী শুয়ে থাকা সুকান্ত'র পাশে বসে পড়ে মাঝে মাঝে। বলে, আমাদের কোথাও কি ভুল হচ্ছে কিছু?
ক'দিন আগে দুর্গাপুজো গেল। পুজোর কাজে সুকান্ত-মঞ্জরী দু'জনেই ছিল। কেউ আপত্তি করে না। ওসব আর আগের মত নেই।
সুকান্ত বলে, ক্ষমতাই আসল কথা জানো তো। এটা আমাদের স্যার বলতেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা, আর অর্থনৈতিক ক্ষমতা। শিক্ষা মানুষে মানুষে ভেদ ঘোচাতে পারে না, তবে এত দ্বন্দ্ব থাকত না। ওদেশের গল্প বলে সুকান্ত, দেখো না সাদা-কালোতে ধর্ম এক, এত শিক্ষিত ওরা, তবু… দেখো তবু এত দ্বন্দ্ব। এত হিংসা।
সুকান্ত আর মঞ্জরী এসব গল্প করত। তখনও আশীষ, রচনা হয়নি। রেলের কোয়াটার্সের বাইরে বসে বসে গল্প করত। প্রথম প্রথম তাদের সঙ্গে সবাই তেমন মিশত না, কিন্তু এখন মোটামুটি সবাই মেশে।
=====
সুকান্ত'র পড়ার নেশা। তার টেবিলের উপর লুথার কিং, আম্বেদকরের ছবি। সুকান্ত সমাজ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে। লেখালেখি করে। মাসে প্রায়ই উইক এণ্ডে গিয়ে গ্রামে থেকে আসে। তবে এখন আর আগের মত পারে না। এখন বলে বেশি, লেখে বেশি। রাগটাও যেন আগের থেকে বেশি।
কারণ কি ছেলেমেয়েরা? নাকি কোনোরকম মোহভঙ্গ? বুঝতে পারে না মঞ্জরী।
=====
সমস্যাটা শুরু হল এবার ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের। আশীষ এবার পুজোতে গ্রামে যেতে চাইল না। সুকান্ত'র স্বভাবে কাউকে জোর করা আসে না। মনে মনে ফোঁসে। আচরণে বোঝা যায়। অভিমান করে ছোটোখাটো বিষয়ে। মঞ্জরীর উপর রাগ দেখায় সব চাইতে বেশি। রচনা বাবার প্রাণ। এই সময়ে রচনাকেও দূরে রাখে। সারাদিন বই মুখে করে বসে থাকে অফিস থেকে ফিরে।
আশীষ বলল, বাবা যদি জেদ করে আমি কিন্তু পরিতোষদের বাড়ি চলে যাব।
পরিতোষ বসাক। লাইনের ওপারে ওদের বাড়ি। ওর বাবাও রেলে কাজ করে। মঞ্জরী ভয় পেলো। সুকান্তকে বোঝাতে গেল। সুকান্ত চুপ করে শুনল। কিছু বলল না।
=====
মঞ্জরী ভেবেছিল, ঝড়টা থেমে গেছে। কিন্তু আসলে তা নয়। দু'দিন পর ঝড় এলো বিরাট আকারে। বাবা-ছেলেতে ধুন্ধুমার কাণ্ড হল। ছেলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল, তখন রাত সাড়ে ন'টা। সুকান্ত আর কাউকে না পেয়ে মঞ্জরীর উপর চিৎকার শুরু করল।
"আসলে কি জানো তো… পৃথিবীতে দুটোই জাত…. এক ক্ষমতাহীনের…. আর দুই ক্ষমতাবানের। তোমরা এখন ক্ষমতাবান হয়েছ……"
মঞ্জরী জানে এই সময় কথা বলার কোনো মানে হয় না। রচনা সিঁটিয়ে আছে ভয়ে। মঞ্জরী বলল, তুমি অঙ্ক বই বার করো, আমি দেখি কতটা হয়েছে।
=====
আশীষ পরিতোষের বাড়ি ছিল। ওর বাবা আর আরো ক'জন সুকান্ত'র বন্ধু পরেরদিন এলো। সুকান্তকে বোঝালো। সবাই রেলে কাজ করে। জ্যোতির্ময়দাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সুকান্ত। বলে, এত উদারচেতা মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। জ্যোতির্ময়দা দু'বছর পর রিটায়ার করবে। রেলের শ্রমিক ইউনিয়নের লিডার। খুব পড়াশোনা করা মানুষ। বিয়ে করেনি। নৈহাটির মানুষ। ওঁর ঠাকুরদা নাকি ভাটপাড়ার বিরাট পণ্ডিত ছিলেন।
=====
সুকান্ত বাইরে শান্ত হল এ ঘটনাটার পর। আশীষ বাবাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। আশীষের ইচ্ছা ডাক্তারি পড়ার। সুকান্তেরও স্বপ্ন তাই। মঞ্জরী সেই স্বপ্নটাকেই মনে করালো সুকান্তকে। "তুমি এরকম জেদ ধরে থাকলে ওর পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, এটা তো মানবে?.... ছেলেটার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে….. তোমার কি মনে হয় ও যেভাবে মানুষ হয়েছে গ্রামে গিয়ে আর থাকতে পারবে?.... ওকে তো না খেয়ে মরতে হবে গো….
মঞ্জরী কেঁদে ফেলল।
কিন্তু মঞ্জরীর কান্না ততটা বিহ্বল করল না সুকান্তকে যতটা করল আশীষের ওরকম ভয়ংকর ভবিষ্যতের ভাবনাটা।
সুকান্ত দমে গেল।
=====
মঞ্জরী খেয়াল করল সেদিন থেকে সুকান্ত যেন দুটো মানুষ হয়ে গেল। এক-একসময় ভীষণ কথা বলে, হাসাহাসি করে, আবার ক'দিন পর দমে যায়।
ঘটনাটা আরো বদলে গেল জ্যোতির্ময়দার হঠাৎ মারা যাওয়াতে। জ্যোতির্ময়দার এক বোন থাকত দমদমে। ওদের বাড়ি কালীপুজো ছিল। জ্যোতির্ময়দা নাস্তিক মানুষ ছিল। কিন্তু বোনকে ভীষণ ভালোবাসত। সুকান্তকে বলল, চলো হে, বোনটা ভালো রাঁধে, ফ্রায়েড রাইস আর আলুর দম খেয়ে আসি চলো।
সুকান্ত জ্যোতির্ময়দাকে না করে না। গেল। রাতে ঘুমের মধ্যেই জ্যোতির্ময়দা চলে গেল। সুকান্ত যদিও লাস্ট ট্রেনে কাঁচরাপাড়ায় চলে এসেছিল। ভোরে খবর পেয়েই আবার ছুটল।
=====
আশীষ কলকাতায় পড়ছে। ডাক্তারি। মাসে একবার করে বাড়ি আসে। রচনার নিজের জগৎ তৈরি হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে রচনাকে চিনতে পারে না মঞ্জরী। ইংরাজি গান শোনে দিনরাত। আরো কি সব কোরিয়ান ব্যাণ্ড। কিচ্ছু বোঝে না মঞ্জরী। সুকান্ত অন্য মানুষ হয়ে গেছে। আজকাল কথাই বলে না প্রায়। সারাদিন এই ওই সংগঠনের নাম করে বাড়ির বাইরেই থাকে। মঞ্জরী বোঝে। সুকান্ত গ্রামে যায়। কিন্তু ফিরে আসার পর আগের মত মুখের সেই ঔজ্জ্বল্যটা খুঁজে পায় না মঞ্জরী। তারা দুটো পাশাপাশি ঘরে আলাদাই থাকে বেশিরভাগ সময়। যেন বিচ্ছিন্ন দুটো দ্বীপ।
রচনা যেদিন খাওয়ার টেবিলে বসে বলল, সে বড় হয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চায়, সুকান্ত সেদিন কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বেশ তো রে মা।
মঞ্জরীর কান্না পেল। একটা হেরে যাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর পেল যেন। কিন্তু কার কাছে হেরে গেল সুকান্ত? মঞ্জরীর হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল। উঠে গিয়ে ঠাস্ করে একটা চড় মারল রচনার গালে। বলল, লজ্জা করে না বাবার সামনে ওসব কথা বলতে……
রচনা উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সুকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ধৈর্য রাখো মঞ্জরী…. নইলে সব শেষ হয়ে যাবে…. সব...
মঞ্জরী সুকান্ত'র কাছে যেতে গেল। কিন্তু কি এক অজানা ভয়ে এগোলো না। চারদিক শূন্য মনে হচ্ছে। কি ভীষণ শূন্য! বুকের মধ্যে মাদলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তালে তালে যেন নাচতে পারছে না। পা জড়িয়ে যাচ্ছে। হাত ঘেমে যাচ্ছে। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
সুকান্ত উঠে গেল। বাইরে উঠানে গিয়ে বসবে এখন। মাথার উপর তারারা। সেদিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। কাকে খোঁজে সে? গ্রামের আকাশ, না গ্রামের মাটি?