লোকটা বাগান খুব ভালোবাসত। রোজ রোজ তার বাগানে কত রঙের, কত রকমের ফুল ফোটে। লোকটা সকালে উঠে বাগানে আসে। খুব খুশি হয়, আবার দুঃখও পায়। কেন দুঃখ পায়? কারণ একটু পরেই একজন লোক আসবে, সব ফুল তুলে নিয়ে গাড়িতে ফেলবে, বাজারে চলে যাবে। লোকটা শুধু একটা ফুল রোজ বাঁচিয়ে নিয়ে আসে তার বউয়ের জন্য। কিন্তু তাও রোজ হয় না, এক একদিন সেই ফুলটাও নিয়ে চলে যায় ওই বাজারের লোকটা।
একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। লোকটা বাগানের ফুলগুলো দেখতে এসেছে একা একা। আজ তার বউও এসেছে তার সঙ্গে। তারা দুজনেই খেয়াল করল, আরে একি! একটা কি অদ্ভুত নীল ফুল ফুটেছে, তার মধ্যেটা লাল আর সবুজের ছিটছিট। কিন্তু এই ফুলটা তো সে লাগায়নি। তবে? বউ বলল, এই ফুলটা আমি নিই? লোকটা বলল, নাও।
বউটা যেই না ফুলটায় হাত দিতে গেছে, অমনি বাজারের লোকটা খপ করে বউটার হাত ধরে ফেলে বলল, খবরদার না, এটা অনেক দামে বিক্রি হবে বাজারে। দিয়ে দাও!
আসলে ফুলটা দেখতে এরা এত মগ্ন ছিল যে লোকটা কখন এসেছে খেয়ালই করেনি। সে সব ফুল নিয়ে চলে গেল।
লোকটা আর তার বউয়ের সেদিন খুব মন খারাপ। তারা দুজনেই তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু শুলে কি হবে, ঘুম আসছে কই? খায়ওনি রাতে তারা কিছু। লোকটা খানিক এপাশ ওপাশ করে, উঠে জানলার একটা পাল্লা খুলে দেখে কি, আরেব্বাস, এতো সারা পৃথিবী চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে! কখন যে মেঘ কেটে গেছে তারা জানতেই পারেনি। লোকটা জানলাটা পুরো খুলে দিতেই ঘরের মধ্যে আলো ঢুকে পড়ল। খাট, মেঝে, আয়না, বাসনকোসন সব চাঁদের আলোয় ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠল। লোকটা বউকে বলল, এসো বাইরে যাই।
বাইরে এসে তো তাজ্জব! চারদিকে সেই নীলফুলটা ফুটে আছে। গাছ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ফুলগুলো সব দেখা যাচ্ছে। কি মিষ্টি গন্ধ! বউ বলল, আজ আমার একটা ফুলও তুলতে ইচ্ছা করছে না। লোকটা বলল, আজ আমারও একটা ফুলও বিক্রি করতে ইচ্ছা নেই। এই বলে তারা মাঠের মধ্যেই শুয়ে পড়ল। যেন তারা নীলফুল আর চাঁদের আলোর মধ্যে মিশে গেল।
পরেরদিন বাজারের লোকটা এসে দেখে বাগানে এত এত ফুল ফুটে আছে, কিন্তু মালী নেই। সে একে তাকে জিজ্ঞাসা করে মালীর বাড়ি খুঁজে বার করল। দেখল বাড়ির মধ্যে ফাঁকা। সারা ঘর সাদা গুঁড়োগুঁড়ো কি সব পড়ে আছে। আর বাইরে মাঠের মধ্যে নীল নীল বিন্দু। সে যত কাছে যেতে গেল সেই নীলবিন্দুগুলো শুকিয়ে যেতে লাগল। মাটিতে বসে উবু হয়ে নীলবিন্দু ধরার চেষ্টা করল, সব মিলিয়ে গেল। লোকটার প্রথমে খুব রাগ হল। তারপর কষ্ট হল। তারপর কান্না পেল। তার মেয়ের কথা মনে পড়ল, তার বউয়ের কথা মনে পড়ল। সবাই এরকমই সে কাছে গেলেই দূরে দূরে চলে যায়। সে মাঠে বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করল। তার চোখের জল তার গাল গড়িয়ে যেই না মাটিতে পড়েছে অমনি সেটা এক বিন্দু নীল জল হয়ে গেল। লোকটা এত কাঁদল, এত কাঁদল যে তার চারদিকে একটা ছোটো নীল জলের পুকুর হয়ে গেল যেন।
লোকটা উঠে বাগানে এলো। তার বাগানভরা ফুল দেখে মনটা আজ এই প্রথম কি খুশি হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল কেন ফুলগুলো গাড়িতে তোলার সময় মালীর মুখটা অমন শুকিয়ে যেত। সে ঠিক করল এখন থেকে এভাবে সব ফুল নিয়ে বাজারে যাবে না, কিছু ফুল বাগানেই থাকবে বাগানের জন্য, যতটা দরকার শুধু ততটাই নেবে।
অনেকদিন হয়ে গেল, এখন সে মাঝে মাঝে বউ আর মেয়েকে নিয়ে বাগানে আসে ঘুরতে। মালীর ফাঁকা বাড়িটায় যায়। সে বাড়িটার চারদিকে কি দারুণ দারুণ সব ফুল ফুটে আছে। তার মালীর কথা মনে পড়ে দুঃখ হয়। যত দুঃখ হয় তত ফুলের উপর ভালোবাসা বাড়ে। সে কেবল বুঝতে পারে না, মালীর বাড়ির সামনে দুটো নীলফুল সব সময় পাশাপাশি কি করে ফুটে থাকে। সে যত ওদুটো ফুল দেখে তত তার মন উদাস হয়! একদিন তার বাচ্চা মেয়েটা ওইদুটো ফুলের কাছে গিয়ে বলে, বাবা এদিকে তাড়াতাড়ি এসো, দেখো ফুলের মধ্যে কি দারুণ মানুষের চোখ আঁকা!
লোকটা কাছে গিয়ে দেখে সত্যিই তো তাই! তার মনে পড়ল এ চোখ সে কোথায় দেখেছে, এতো মালীর চোখজোড়া! সে এক মুঠো মাটি সে গাছের গোড়ায় দিয়ে বলল, আমায় ক্ষমা কোরো! তার মন থেকে যেন জন্মান্তরের ভার নেমে গেল।