সৌরভ ভট্টাচার্য
6 October 2019
সকাল থেকে একটা মালাও বিক্রি হয়নি। বাড়ি গেলে মা মারবে। খুব জ্বর মায়ের, বিছানায় শুয়ে। আসলে মালাগুলো বিক্রি হবে না সে জানত, অনেকগুলো ফুলে কালো কালো দাগ।
বাচ্চা মেয়েটা একটা বাড়ির রকে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্তিতে। দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। মেয়েটার তাও ঘুম ভাঙল না। ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধ্যে হব হব। তার মালাগুলো বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে একশা। আর কি এ মালা বিক্রি হবে? তবু সে ভিজে মালাগুলো নিয়ে বাজারের এক কোণায় এসে দাঁড়ালো। সামনে মন্দির, শ'য়ে শ'য়ে ভক্তের ভিড়। তার মালা কি এরা কেউ কিনবে না?
মেয়েটার কান্না পেল। সারাদিনের ক্লান্তি, হতাশা, খিদে মিশে তার কান্নাকে বলল, থাক, কি হবে?
মেয়েটা অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করল। কেউ তার মালা নেওয়া তো দূরের কথা, সে যে দাঁড়িয়ে আছে তাই খেয়াল করল না কেউ। সে মালাগুলো নিয়ে মন্দিরের চাতালে রেখে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। ক্লান্ত পায়ে, অবসন্ন মনে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছে তার মা তাকে কি কি বলতে পারে... মারতে উঠবে কিনা এই জ্বর গায়ে...., হঠাৎ তার পিছন থেকে কে যেন ডাকল...
মন্দিরের সামনের ভিখারিটা। খোঁড়া, বুড়ো একটা। সে এগিয়ে এসে বলল, তোমার এ মালাগুলো ফেলে রেখে এসেছিলে, সে কি ইচ্ছা করে, নাকি ভুলে গিয়ে?
মেয়েটা কি বলবে ভেবে পেল না।
বয়স্ক মানুষটা তাকে বলল, আমি তোমার এ মালাগুলো কিনব, আমায় বেচবে?
মেয়েটা ভাবল একবার জিজ্ঞাসা করে, কেন? এ মালা নিয়ে তুমি কি করবে?
কিন্তু জিজ্ঞাসা করল না, বড্ড খিদে পেয়েছে। বাড়ি যাবে। সে শুধু মাথা নাড়ল।
বাড়ি ফিরে দেখে তার মা তার জন্যে চৌকিতে বসে জানলার দিকে তাকিয়ে। সে যেতেই বলল, স্নান করে আয়, ভাত বেড়ে দিই।
মেয়েটা কিচ্ছু না বলে, স্নান সেরে খেতে বসল।
তার মা বলল, তুই শুনেছিস?
মেয়েটা বলল, কি?
মন্দিরের সামনে যে ভিখারিটা রোজ ভিক্ষা করত সে আজ বিকালে মারা গেছে। ও নাকি চারদিন ভিক্ষা করতেই বেরোতে পারেনি এত জ্বর ছিল। যা হোক বয়েসও হয়েছিল।
মেয়েটা কিছু না বলে ভাতের থালা ফেলে দৌড় দিল। হাঁপাতে হাঁপাতে মন্দিরের কাছে এসে দেখে সেই বুড়ো ভিখারিকে খাটে শোয়ানো হয়েছে, মন্দিরের সামনে রাখা হয়েছে, এখানেই সারাজীবন কাটালো তো, তাই।
মেয়েটা দেখল তার গলায় তার মালাগুলো।
পুরোহিত মেয়েটাকে ডেকে বলল, তোমার মালাগুলো খুব সুন্দর, আমার এতদিন চোখেই পড়েনি, ভোলাটার গলায় কি চমৎকার মানিয়েছে দেখো, তুমি প্রতিদিন ষোলোটা করে মালা আনবে মন্দিরের পুজোর জন্যে, কেমন?
মেয়েটা অর্ধভুক্ত শরীরে ক্লান্ত দুটো চোখ মেলে কিছু বলতে গেল... ঝাপসা হয়ে গেল।