Skip to main content
maa go

এরকম মীরজাফর টাইপের বন্ধুবান্ধব থাকলে যা হয় আর কি! নইলে এ লেখা কেউ লেখে? আরে লোকে না মানুক আমি একজন কেউকেটা টাইপের আদমি, আমি নিজে তো মানি। এ লেখা লিখলে নিজের মান ইজ্জতের কাবাড়া হবে না? কিন্তু তাদের বায়না, লিখতেই হবে। অগত্যা লিখি।

ঘটনার সূত্রপাত হল যেদিন ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের খেলা হবে সেই দিন। থুড়ি সেই রাত। বাবা বললেন, ওহে, আজ খেলা আমরা একসঙ্গে দেখব!

আপনারা শুনে ভাববেন, এ আর এমন কি কথা, এমন শীতের রাত, এমন বিশ্বকাপ, এসব দেখা তো দারুণ ব্যাপার!

উঁহু। গোড়াতেই গলদ। খেলা আমি আর দেখলাম কবে? মানব মনের যাবতীয় লীলাখেলায় মজে বাস্তবিক খেলাধুলা দেখা আর হল কই? অবশ্য কথাটা এতটা দার্শনিক তুল্যও নয়। আসলে ছোটোবেলা আর কিশোরবেলায় এত জ্বর-সর্দি-কাশি ইত্যাদি ইত্যাদিতে ভুগতাম হয় তো সেই জন্যেই মাঠের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক তৈরি হয়নি। আমাদের পরিবারে একটা কথা প্রচলিত ছিল আমাকে নিয়ে, আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে গিয়ে আবহাওয়ার গতিবিধি না জানলেও হবে, তার জন্যে আমিই ছিলাম যথেষ্ট।

কথাটা খুব মিথ্যা অবশ্যই নয়। দেহে যতটুকু মাংস আর হাড় না রাখলে জীববিজ্ঞান মতে প্রাণধারণ অসম্ভব, তার বেশি আমার শরীরে কেউ দেখেছে, এ আমার অতি দুষ্ট নিন্দুকেও বলবে না। তো সেই শরীরে মাঠে আর কি নামি!

একবার খুব ছোটোবেলায় অবশ্য ক্রিকেট খেলতে নিয়ে গিয়েছিল রেলকলোনির বন্ধুরা। এখন ক্লাস ফোর অবধি পড়লাম ঘিঞ্জি শহর হাওড়ার সালকিয়ায়, তারপর এলাম কাঁচরাপাড়ায়, এসেই দেখি এত বড় বড় মাঠ... তা আমি কি ছাই ক্রিকেট খেলা দেখেছি আগে? সে আমি জানলে কি হবে, আমার বন্ধুরা তো জানে না। তারা আমায় ফিল্ডিং করতে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু আমায় শিক্ষা দিল অভিমন্যুর মত। অর্ধেক শিক্ষা। বলল, বল গেলে কুড়িয়ে, ছুঁড়ে দিলেই হবে।

বেশ। দাঁড়ালাম। বল এলো। কুড়ালাম। ওমা! দেখি দুজন মানুষ হঠাৎ রাস্তায় পায়খানা চেপে গেলে যেমন দৌড়ায়, তেমন পাগলের মত এদিক ওদিক করছে। আর সবাই আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। আর বলছে, ছোঁড়… ছোঁড়….

আমি এদিকে ভাবছি, দু'জন মানুষ অমন পাগলের মত উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়াচ্ছে, আগে তার কারণটা বুঝি… তাছাড়া যদি কারোর গায়ে লেগে যায়…

আর ভাবাভাবি… ওদিকে দেখি আমার কিছু বন্ধু বেজায় চটে রীতিমতো অভিধানিক ভাষায় এমন কিছু শব্দ বলছে যার অর্থ না বুঝলেও উষ্মা অনুভব করতে পারছি।

দিলাম বল ছুঁড়ে। তারা আমায় খেলা থেকে বাদ দিল, আমিও বাড়ি ফিরে বাঁচলাম।

তো যেটা বলছিলাম, খেলার সঙ্গে দোস্তি তো হল না। হল বইয়ের সঙ্গে। প্রকৃতির সঙ্গে।

 

=========

 

আবার বর্তমান প্রসঙ্গে ফিরি। বাবা আমন্ত্রণ জানালেন, তাঁর সঙ্গে আমায় খেলা দেখতে হবে।

বাবা অসুস্থ মানুষ। চব্বিশ ঘন্টা দেখভালের লোক থাকে সঙ্গে। তাছাড়া রেলে চাকরি করার সময়ে, রেলের তাসের টিম, কন্ট্র‍্যাক্ট ব্রিজের, নিজে অধিনায়কত্ব করেছেন, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। বিদেশেও গেছেন খেলতে অনেকবার। শ্রী সরোজ ভট্টাচার্য নামটা অনেকেই বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে নেন তাসের জগতে। খেলা পাগল মানুষ। খেলা দেখায় ডুবে থাকেন রাতদিন। ট্যাবে তাস দেখছেন। টিভিতে বাকি যাবতীয় যা কিছু খেলা দেখছেন। তাঁর সঙ্গে খেলা দেখতে "না" করা যায়!

আমার ফুটবল খেলা সম্বন্ধে জ্ঞান হল, দু'দল লোক যে করে হোক গোল করার চেষ্টা করবে, যে বেশি পারবে সে জিতবে। তারও একটা ইতিহাস আছে। মাধ্যমিক অবধি আমাদের সিলেবাসে শারীরশিক্ষা বলে একটা বিষয় ছিল। সেই পরীক্ষায় আমি রীতিমতো নার্ভাস ফিল করতাম। ফুটবলের, ক্রিকেটের যাবতীয় যা কিছু নিয়মকানুন "শারীরশিক্ষার রীতিনীতি" বলে একটা বই থেকে মুখস্থ করে যেতাম। সে সব কি এখন মনে আছে?

আর খেলোয়াড়দের নাম? মেসি আর রোনাল্ডো। এর বেশি জানি না। সেও জানি নিজের তড়ানায় নয়। "এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার তলে দাঁড়িয়ে হাতে হাত, চোখে চোখ, কথা যেত হারিয়ে"... এ গান যেমন আমি কোনোদিন বাড়িতে চালিয়ে শুনিনি, তবু জানি। সেরকম।

তো যা হোক। খেলা দেখতে বসলাম। বাবা কম্বল জড়িয়ে বিছানায়। আমি চেয়ারে। খেলা শুরু হল। ইংল্যান্ড বনাম ফ্রান্স।

প্রথমত আমার বুঝতেই সময় লাগল প্রায় দশ মিনিট কোনোটা কার জার্সি। কার পক্ষ নিয়ে দেখব সে তো দূরের কথা! বাবা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। এমন একটা আন্তর্জাতিক মানের উত্তেজনার সামনে আমিই বা চুপ করে স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে বসে থাকি কি করে! আমিও উত্তেজনার আওয়াজ করলাম… এই গোল… গোল… হয়ে যাচ্ছিল আর কি!

তো দাঁড়ালো এই। বাবা বেজায় উত্তেজিত। আমি নকল উত্তেজিত। বাইরের ঘরে রাতের অ্যাটেনন্ডেন্ট নিদ্রারতা! বাবা দু-একবার জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে আমি এত চেঁচাচ্ছি ওতে কি ওর ঘুমের অসুবিধা হবে!

বোঝো! কার অসুবিধার কথা কে জিগায়! তো খেলা তো চলছে। ইতিমধ্যে আমি জানতে পারলাম খেলা যদি নব্বই মিনিটে রফা না হয় তবে নাকি আরো এক্সট্রা টাইম খেলা হয়। সে নাকি মায় সাড়ে তিনটে অবধিও হতে পারে! রক্ষা করো মা!

খাইসে আমারে! এ তুমি আগে বলবা না! এদিকে তো বাবা কর্নার, ফ্রি কিক, অফসাইড বলেই যাচ্ছেন। আমার কানে আসছে, কিন্তু মানে কি এগুলোর? এর মধ্যে আমি মাঝে মাঝে মোবাইলে দু পাতা বইও পড়ার চেষ্টা করছি। কোলে মোবাইলে খোলা ইম্যানুয়েলের 'ক্রিটিক অব প্র‍্যাক্টিকাল রিজন', ওদিকে সামনে স্ক্রিণে এমব্যাপে, ওরফে বাপিদা নামে কেউ। বাবা তার নানা কীর্তির গুণগান করছেন। এদিকে বলতে বলতে গোল। বাবা মুষড়ে পড়লেন, তখন জানলাম বাবা ইংল্যান্ডের সাপোর্টার ছিলেন। আর আমি? আমি খালি ভাবছি আর যা হোক এক্সট্রা টাইম যেন না হয়! ওদিকে বেকহ্যাম মন খারাপ করে বসে। বাবার তাই দেখে আরো মন খারাপ। কিন্তু ঘটনার জটিলতা বাড়ল বিরতির পর।

আরে আমাকে তো কেউ বলবে যে বিরতির পর গোলকিপার দু'জন জায়গা পাল্টাপাল্টি করে আর খেলার মুখ এমন ঘুরে যায়। আমি ভাবছি তবে কি হল কেসটা? এরা উল্টোদিকে দৌড়ায় কেন? বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কি জার্সি পাল্টাপাল্টি করে এলো নাকি গোলপোস্ট ঘুরে গেল?

প্রথম কথা বাবা দুবার প্রশ্নটাই বুঝতে পারলেন না। উনি উত্তরে কি সব বলছেন, আমার মাথায় ঢুকছে না। এদিকে রাত ঘনিয়েছে। রাত মানেই সবার নেশার সময়। আমার নেশা বইয়ের পাতা। ইম্যানুয়েল হাই তুলছে। আমি ঢুলুনি আটকিয়ে বাবাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, বলি হচ্ছেটা কি? এরা কি নিজের গোলে গোল দেবে?

বাবা এইবার বুঝে, দু'বার হেঁচকি তুলে বললেন, আরে বোঝো কাণ্ড… তাও জানিস না… এটাই তো নিয়ম।

ওদিকে হঠাৎ দেখি বল নিয়ে একজন গোলপোস্টের সামনে, গোলকিপার শকুনের মত কুতকুতে চোখে বলের দিকে তাকিয়ে। এটা কোনো কথা? একে নাকি পেনাল্টি বলে। এই একটা রোগা মানুষ অতবড় গোলপোস্টের হাঁ মুখ সামলাতে পারে? হয় দুটো গোলকিপার দে, নইলে দুটো বাঁশ পুঁতে ছোটো কর গোলপোস্টের হাঁ মুখ! তা করল না। ওমা, দেখি ধাঁ করে ছাদে গিয়ে মারল বল। মানে গোলপোস্টর ছাদে। বুঝলাম যে মারল তার পক্ষে এতবড় গোলের হাঁ-ও যথেষ্ট নয়। তবে এ হয়। আমি অনেকবার টিপ করে কুলের বিচি, কি খেজুরের বিচি জানলা দিয়ে বাইরে মারতে গিয়ে দেখেছি, কি করে, কি করে ঠিক ব্যাটা জানলার রডে গিয়েই ধাক্কা খেয়ে খাটে এসে পড়ল। ও হয়। মানুষ তো রে বাবা!

তো যা হোক, কপাল আমার ভালো। খেলা মানে মানে শেষ হল।

এইভাবে মেসি বনাম লুকা। এইভাবে বাপিদা বনাম হাকিমি। রাতের পর রাত জাগি। খেলা দেখি আর মনে মনে প্রার্থনা করি, আর যাই হোক মাগো এক্সট্রা টাইম যেন না হয়! না হয় মাগো পুরো 'চণ্ডী' তোকে মুখস্থ করে শোনাব, কিন্তু এ যাত্রায় রক্ষে কর মা! খেলা যেন সময়ে শেষ হয়।

যা হোক, মা কথা শুনেছেন। রাতের ঘুম একটা সময়ের পর এসে বেলায় ছেড়েও গেছে। এ বিশ্বকাপে সব চাইতে শান্তির খবর যা শুনলাম, ফাইনাল নাকি সন্ধ্যাবেলাতেই হবে। শুনে ধড়ে প্রাণ এলো। সে দেখা কি আর এমন কাজ! এখন তো মেসি আর বাপিদা দুজনকেই চিনি। আর বিরতির পর গোলপোস্ট ঘুরে যায় সেও জানি। দেখে নিলেই হবে। কাকে সাপোর্ট করব? আবার সেই গান, "আজ এখানে আমার আশার সমাধি"... আমি ছোটোবেলায় ভাবতাম 'আশা' নামে কেউ হবে তার সমাধি বুঝি। সমাধি। খেলার হার জিতে কার কার আশার সমাধি হবে জানি না। তবে আমার কথা হল বাড়ির বয়স্ক ক্রীড়াপ্রেমীরা সুস্থ থাকলেই হল। যা ধকল গেল, বাবা গো বাবা!

 

(ছবি - Suman Das)