মাধুরী দীক্ষিত,
এতদিন আপনার অনুরাগী ছিলাম নাচের, লাবণ্যের, হাসির। আপনার প্রচুর সিনেমা যে দেখেছি তা নয়, হাতে গোনা কটা দেখেছি, তবে আপনাকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি বারবার। এক সময়ে খুব চর্চা হত আপনার হাসির সঙ্গে সুচিত্রা সেনের মিল আছে। সে প্রশ্ন আপনাকেও করা হয়েছিল। আপনি বলেছিলেন আপনি শুনেছেন, এবং সুচিত্রা সেনের কিছু সিনেমাও আপনি দেখেছেন, যেমন ‘মমতা’, ‘আঁধি’ ইত্যাদি। আপনি সত্যিই ভীষণ সুন্দরী, আমি আর আমার মা আপনার সৌন্দর্যের, ব্যক্তিত্বের একান্ত অনুরাগী অবশ্যই ছিলাম, বিশেষ করে নাচের। আপনি যখন অনেকদিন পর ‘আজা নাচলে’ করেন, আমি আর মা একসঙ্গে দেখেছিলাম। কারণ আপনি আমাদের দু’জনেরই হার্টথ্রব ছিলেন।
তবে আজ আপনি আমায় চমকে দিলেন। আর সেই জন্যেই এই লেখা লিখতে বসা। দেখুন এতদিনের সিনেমায় আপনার একটা ইমেজ তো অবশ্যই তৈরি হয়েছে। আপনি পরমা সুন্দরী, আপনি আদর্শ নায়িকা ইত্যাদি। কিন্তু আপাতত শেষ সিনেমায় নিজেকে এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করার সাহস দেখালেন, আমি সত্যিই আশ্চর্য হলাম। আপনার প্রতি এতদিন মুগ্ধতা ছিল। আজ শ্রদ্ধাও জন্মালো। আপনি ‘মজা মা’ সিনেমায় একজন লেসবিয়ানের অভিনয় করলেন। আশ্চর্যরকম ভাবে করলেন। সিনেমাটা কেমন সে নিয়ে আলোচনায় আমি আসছি না। আমি বিষয়টা নির্বাচনের কথা বলছি। আপনি সে সাহসটা দেখিয়েছেন।
আপনার নিশ্চয় মনে আছে, দীপা মেহেতার ‘ফায়ার’ সিনেমার কথা। ১৯৯৬ সাল। শাবানা আজমী আর নন্দিতা দাস। কিছুতেই সিনেমা হতে দেওয়া হবে না। এমনকি সিনেমা হল ভাঙচুর হল কিছু। কারণ লেসবিয়ান বিষয়টা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নাকি। সবাই বলেনি। কিছু কিছু মানুষ বলেছিল। তারা আজও আছে। কিন্তু তারা থাকা সত্ত্বেও দোস্তানা, মাই ব্রাদার নিখিল, শুভ মঙ্গল জাদা সাবধান, ইত্যাদি অনেক অনেক সিনেমা হয়ে গেল যা ভিন্ন যৌনতার গল্প বলে। সে সব হলেও চলল। ওটিটিতেও চলল। ভারতকে এক কথায়, এক লাইনে ব্যাখ্যা করতে যারাই চেয়েছে তারাই এই ভুলটা করেছে। ভারত কোনো একটা ধর্মগ্রন্থ দিয়ে কোনোদিনই নিয়ন্ত্রিত ছিল না, হবেও না। এক গ্রন্থ বলতে যদি না সেটা সংবিধান হয়। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা কখনওই ভারতের পুরো ছবি অবশ্যই নয়।
কয়েকদিন হল ফরাসী নোবেল বিজেতা লেখিকা আনা এরনোকে নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি লিখেছেন। নারীর সুপ্ত বাসনা নিয়ে লিখেছেন। সব আলোচনা যে খুব সাহিত্যের প্রতি অনুরাগে হচ্ছে তা নয়, যেমন ছবির গ্রুপে দেখা যায় কোনো নগ্ন নারীর ছবি দেওয়ার সময় ছবির লাইকের সংখ্যা অসম্ভব বেড়ে যায়। কেউ আপত্তি জানালে শিল্পের এমন সুক্ষ্ম আলোচনা শুরু হয় যে যেন শিল্পের সবটুকু সার নির্যাস নগ্ন নারীর সৌন্দর্য ছাড়া আর কোথাও নেই। নগ্নতা অবশ্যই শিল্প, তবে কোন মনের কাছে সেটা বড় প্রশ্ন। দমিত আগ্রাসী ক্ষুধা, নাকি মার্জিত দৃষ্টি? এর পরীক্ষা কে করবে? কেউ না। এ নিজের নিজের বোধ।
এরনোর লেখার মধ্যে সব থেকে বড় কথা সাহিত্য। মর্মের কথা। আজ যখন সিনেমাটা দেখছিলাম আমার বারবার এরনোর কিছু লাইন মনে পড়ছিল। আপনি যখন আপনার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছেন, “সঙ্গমের সময়ে তুমি তো কোনোদিন জিজ্ঞাসা করোনি আমি কি চাই?” কিম্বা আরেকটা দৃশ্যে যখন আপনার স্বামী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করছেন আরেকজন পুরুষকে, মেয়েদের মনেও এমন নোংরা চিন্তা আসে? হ্যাঁ, এই শব্দটাই শোনানো হয়েছে - নোংরা। কারণ ছেলেদের কাছে ওই নোংরামিটা সমাজে অনুমোদিত। কাগজে কলমে নয়, বিশ্বাসে।
গত বছর স্প্যানিশ ভাষায় একটা সিনেমা হয়, ‘প্যারালাল মাদার্স’। দুজন সিঙ্গল মাদারের গল্প। তাদের মধ্যে একজন স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে নির্যাতিত মৃত আত্মীয়দের মধ্যে নিজের বংশের সূত্র, মর্যাদা খুঁজছে, যা রাষ্ট্র তাকে দেয়নি। আরেকজন অল্প বয়েসী। সে নিজের অস্তিত্বের মানে খুঁজছে বাবা মায়ের সম্পর্কের নানা জটিল দ্বন্দ্বের মধ্যে। তার মা-ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে নিজের মত করে মাতৃত্বকে উপেক্ষা করেও। আর মেয়ে নিজেকে খুঁজতে চাইছে মাতৃত্বের মধ্যেই।
দু’জন সিঙ্গল মাদার একে অন্যের কাছাকাছি আসে। শরীরও জেগে ওঠে। কিন্তু যৌনতা মানে কি সম্পর্ক? সম্পর্ক কি যৌনতা ছাপিয়ে আরো কিছু নয়? জটিলতা বাড়ে। কিন্তু দুজনেই সত্যকে চায়। এরনো সত্যকে চায়। আপনিও সত্যকে চান। তাই লাই ডিটেক্টর টেস্টে যখন আপনি প্রমাণিত হন না যে আপনি লেসবিয়ান তখন আপনার ছেলে যখন প্রশ্ন করে, কি করে করলে? আপনি অসামান্য একটা উত্তর দেন। আপনি বলেন ওই টেস্টে ওদের প্রশ্নটাই ভুল ছিল। ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কোনো মহিলার সঙ্গে সেক্স করেছিলেন কিনা। যার উত্তর অবশ্যই, না। তারা জিজ্ঞাসা করেনি, আপনি কোনো মহিলাকে ভালোবেসেছিলেন কিনা। যার উত্তর হত, হ্যাঁ।
এরনো, আপনি, স্প্যানিশ সিনেমায় দুই সিঙ্গল মাদার, আপনারা প্রত্যেকেই সত্যকে খুঁড়ছেন। যে সত্য সমাজ, সংস্কার চেপে রাখতে চাইছে। একটা মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু মানুষের আত্মা জাগলে সে সত্যকেই চাইবে। এই মানুষের ভবিতব্য। আজ অবধি যত বিপ্লব মানুষের অধিকারের জন্য হয়েছে তা মানুষের এই সত্যের স্পৃহার জন্যেই হয়েছে। তার জন্য যত দুর্গম রাস্তা, যত অত্যাচার, যত পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে, মানুষ করেছে। স্বীকার করে নিয়েছে। মানুষের ইতিহাসকে বিকৃত করে রাখা যায় না, চেপে রাখা যায় না, স্প্যানিশ সিনেমার শেষে বলা হয়েছে। মানুষের সত্যকেও চেপে রাখা যায় না। সে সত্য ব্যক্তিগত হোক কি সমষ্টিগত। সত্যকে জানলে তাকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া মানুষের আর গতি নেই, এটাই মনুষ্যত্বের মহিমা। এটাই সব শেষে আশার কথা। দরকার শুধু সৎ সাহসের। আপনি সেটা দেখিয়েছেন, নিজের ইমেজের আরেকটা বিকল্প হয়েই হয় তো।
আপনাকে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ সিনেমাটায় এই চরিত্রটাকে স্বীকার করার জন্য।