Skip to main content

ধ্যানে যখন বসে তখন সব কেমন সুন্দর, সবের মধ্যে কি সুন্দর শান্তি, সামঞ্জস্য।

 

ধ্যান থেকে উঠে, নিত্যকর্ম সেরে মন্দির বন্ধ করে সাইকেলটা নিয়ে যখন রাস্তায় নামে পরমানন্দ, মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। সমাজ আর তার ধ্যানের জগতে কিছুতেই বনিবনা হয় না। সমাজে এত অসামঞ্জস্য, এত অবিচার, এত দুঃখ, এত পাপ, এত নিষ্ঠুরতা। এর কোনো সমাধান খুঁজে পায় না সে। গুরু বলেন, ও মায়া, ও লীলা। পরমানন্দের মন সাড়া দেয় না। ধ্যানের সুন্দর, সমাজে বিরসবদনে তাকিয়ে থাকে। ধ্যানেতে প্রসন্ন দৃষ্টি যার, সেই তিনি সমাজে ক্ষুধার্ত, অসহায় দৃষ্টিতে উদাস তাকিয়ে। মিল কোথায়? পরমানন্দ দেখে অনেকেই সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে কোনো না কোনোভাবে নিজেকে নিয়ে মেতে আছে। এই কি ধর্ম? তবে কি স্বার্থপরতাই ধর্ম? সে যত উচ্চতত্ত্বেই তাকে সমর্থন করি না কেন?

মন মানে না। পরমানন্দ ঠিক করল, সে ঈশ্বর আর ধর্মকে ত্যাগ করবে। যাবে না মন্দিরে আর। ছোটো-ছোটো অনাথ বাচ্চাগুলোকে পড়াবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরমানন্দ মন্দিরের কাজে ইস্তফা দিল। বাড়ির সামনে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে স্কুল চালু করল। গরীব বাচ্চারাই তার ছাত্র। সমাজকে উপেক্ষা করতে যে শেখায় সে বানানো ঈশ্বর হতে পারে, বানানো ধর্ম হতে পারে। তবে সে সত্য না।

একদিন স্কুল শেষ করে পরমানন্দ দীঘির ধারে এসে দাঁড়ালো। স্নান করবে। দেখে কিছুটা দূরে বসে তার এক ছাত্র। মাথা নীচু করে কিছু একটা করছে।

পরমানন্দ কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তাকে খেয়াল করেনি সে। সে ছবি আঁকছে। দীঘির মধ্যে একটা বড় বাড়ি। সামনে রাস্তা। দীঘিতে হাঁস চরে বেড়াচ্ছে।

পরমানন্দ বলল, এ কিসের ছবি?

সে চমকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল, আমার বাড়ির ছবি।

পরমানন্দ হাতের থেকে খাতাটা নিয়ে তাকালো। কোথায় দীঘি, কোথায় হাঁস, কোথায় রাস্তা? এতো সেই মন্দির, তার নিজের হাতে সাজানো দেবতা!

ছেলেটা বলছে, আমি এই ছবি আঁকি। আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। আমার তখন কারোর উপর রাগ হয় না, হিংসা হয় না।

পরমানন্দ জিজ্ঞাসা করল, কে শেখালো তোমায় এসব?

মা। আমার মা বলেছেন যে, যাই হোক, নিজের মনকে ছোটো করতে নেই। ছবি আঁকতে হয়। কাগজ পেন্সিল না থাকলে মনে মনেই ছবি আঁকতে হয়। সুন্দর ছবি। ছবি আঁকলে মন থেকে সব হিংসা চলে যায়। রাগ চলে যায়। আবার লড়াই করার শক্তি আসে। মা কি ভুল বলেছে স্যার?

পরমানন্দের মুখ থেকে কথা সরল না। সে বলল, তিনিই ঠিক বলেছেন। তুই আঁক, আমি যাই।

পরমানন্দ দীঘির ধারে বসল। ধ্যানের দরজা খুলে ঢুকল গভীরে। সব ক্ষোভ, সব জ্বালা জুড়িয়ে যাচ্ছে। অন্তরে আনন্দের ছবিকে না পেলে বাইরে তাকে বানায় কি করে মানুষ? খুঁজে পায় কি করে?

সমাজের নতুন ব্যাখ্যা পেলো পরমানন্দ। অন্তরের আবর্জনাকে সমাজে উগরে উগরে সমাজের এই অবস্থা করেছে মানুষ নিজে। অন্তরে শান্তি আর আনন্দের স্রোতকে খুঁজে তাকে বাইরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে যে সে-ই পেয়েছে সামঞ্জস্যের পথ। মানুষের সমাজ তো পশুর সমাজ নয় যে সে শুধু শরীরের প্রয়োজন ফুরিয়েই শেষ হবে, মানুষের সমাজের একটা বড় ভাগ তো তার মন। তার অন্তঃকরণ। নিজে অশুদ্ধ, স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণ হয়ে সমাজের কোন কল্যাণে লাগে মানুষ?

পরমানন্দ স্নান করল। সারারাত ঘুম এলো না আনন্দে। পরেরদিন স্কুলে এসে বলল, আজ থেকে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে আমরা ছবি আঁকব, গান গাইব, কবিতা বলব। না হয় আধপেটা খেয়েই করব। পেট আর মন দুই নিয়ে মানুষ। দু’জনকেই সুস্থ সবল রাখতে হবে, তাই তো?

তার আগের দিনের দীঘির পাশে বসা ছাত্র মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ স্যার.. মা-ও তাই বলেন।