স্বামীজি চিঠিতে লিখছেন, Everything must be sacrificed if necessary for that one sentiment, universality.
দলাদলি নয়। পরনিন্দা পরচর্চা নয়। এমনকি লিখছেন, আমি যদি এখানে মরেও যাই, আর দেশে নাও ফিরি, মনে রেখো শুধুমাত্র সহিষ্ণুতা না, গ্রহণ করো, আচরণে প্রচারে। কারোর ন্যূনতম অধিকারও মাড়িয়ে যেও না, খেয়াল রেখো।
ভারত তো তখন পরাধীন। ১৮৯৪ সাল। ঢের দেরি দেশ স্বাধীন হতে। তখনও দুটো বিশ্বযুদ্ধই বাধেনি। তাও কিভাবে বলছেন? যেন ইউনাইটেড নেশানে বক্তৃতা করছেন! যেন কোনো গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে ভাষণ দিচ্ছেন! আরে ধুর, না তো, চিঠি লিখছেন। তবে কি এমন আদর্শকে জলজ্যান্ত দেখেছেন যে একথা বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে না যে মানুষ একটা সার্বজনীনতায় দাঁড়াতে চাইবে একদিন। এখন যে না হিউম্যান রাইটস্ বলে কিছু একটা আছে। সেদিন কই ছিল?
এমন একটা আদর্শকে দেখেছিলেন, তার নাম ছিল এককথায় - মা। জয়রামবাটীতে তাঁকে সব শ্রেণীর ভক্তদের উচ্ছিষ্ট পরিস্কার করতে দেখে ভাইঝি নলিনী যখন ঘৃণাভরে বলছেন, "মাগো, ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়ুচ্ছে!" শ্রীমার অনায়াস উত্তর: সব যে আমার, ছত্রিশ কোথা?"
এ কথা সার্বজনীন কথা। গ্রহণের কথা। অধিকারে অধিকারী করার কথা। মায়ের শরীরে একটা অদৃশ্য কোষ তিলে তিলে গড়ে উঠছে জগতে নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে বলে। যেদিন নাড়ি কেটে মাটিতে এসে পড়বে সেদিন মায়ের শরীর তাকে স্বাধীন করে গড়ে দিয়েছে - শারীরিক, মানসিক, আত্মিকভাবে জগতে যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে। এ সার্বজনীন ঘটনা।
বুদ্ধের কাছে একজন এসে বলেছে, "ও ব্রাহ্মণ ও নীচুজাত।" বুদ্ধ বলছেন, দু'জনের জন্ম কি আলাদা নিয়মে? তারা কি একই ভাবে মায়ের গর্ভে থেকে জন্মায়নি? অর্থাৎ সেই সার্বজনীনতার প্রশ্ন।
স্বামীজির সার্বজনীনতার আদর্শ বৌদ্ধিক কথার কথা নয়। দেখা, অনুভবের কথা। ঠাকুর রাতদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বলে বেড়াচ্ছেন, দুই কই রে… আমি তো সব একই দেখি। দুই নেই। সব এক। সব মা। শাস্ত্র দিয়ে প্রমাণ করে দেখাচ্ছেন না। নানা তর্কে প্রমাণ করছেন না। শুধু বলছেন, আমিই তো দেখছি সব এক। মা দেখিয়ে দিচ্ছেন।
আজ ইউনিসেফ থেকে বেশ কয়েকটা সুন্দর ছবি দিয়েছে। মাতৃত্বের ছবি। পৃথিবীর নানা দেশের মায়ের ছবি। পোশাক আলাদা, রঙ আলাদা, ঘরবাড়ি আলাদা, কিন্তু শিশুকে কোলে নিয়ে হাসিটা এক।
'একেশ্বরবাদ' আর 'একত্ববাদ'-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। 'মা' শব্দটায় স্বামীজি এই দ্বিতীয় সত্যটাকে দেখেছিলেন। একত্ব। দুই নেই। স্বামীজির বেদবেদান্ত, নিরাকার সাকার সব মিলে আছে ওই একটা শব্দে, মন্ত্রে - মা। এমনকি নিজের শেষদিনেও প্রায় ঘন্টা তিনেক দরজা বন্ধ করে সেই বিশ্বমাতৃত্বের আরাধনায় ডুবেছিলেন। আসলে বিশ্বমাতৃত্ব বলে তো কিছু হয় না। মাতৃত্ব মানেই 'বিশ্বত্ব'। সার্বজনীনতা। স্বামীজি এই শব্দের নীড়েই হয় তো গোটা জগতে শান্তির ছায়া দেখতে চেয়েছিলেন।
(ছবিগুলো ইউনিসেফের পেজ থেকে)