সৌরভ ভট্টাচার্য
5 July 2014
তখন আমরা কাঁচরাপাড়ায় থাকি। রেলের কোয়াটার্সে। দূরে দূরে এক-একটা কোয়াটার্স, সেই ব্রিটিশ আমলে বানানো। কাঠের সিঁড়ি, ইয়া উঁচু ছাদ। সামনে ফাঁকা জমি, তারপর রাস্তা- ফার্স্ট এভিনিউ, সেকেন্ড এভিনিউ.. এরকম সব নাম।
বিকাল বেলা। আমি দোতলার বারান্দায় বসে কিছু একটা পড়ছিলাম। ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, গরমের ছুটি চলছে তখন। পড়ছি, আর মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি, আমার এক বন্ধুর আসার কথা। সে আসলে আমরা বেড়াতে বেরোব।
মাঝে হঠাৎ রাস্তায় চোখ রাখতেই দেখলাম দু'জন ভদ্রলোক আমাদের কোয়াটার্সের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলাবলি করছেন নিজেদের মধ্যে। ঘড়ি দেখলাম। চারটে বাজে। না, এখনো কারখানা ছুটি হতে আধঘন্টা বাকি। বাবাকে খুঁজছেন কি? যা হোক গুরুত্ব দিলাম না, দরকার হলে তো আসবেনই।
কিছুক্ষণ পর দেখি তাও দাঁড়িয়ে। এবার সত্যি আশ্চর্য লাগল। কি দরকার রে বাবা! নীচে নামলাম।
"কাউকে চাই?", জানতে চাইলাম।
দুজনের কাছাকাছি বয়স মনে হল, তা পঞ্চাশের কাছে। ফরম্যাল জামা-প্যান্ট।
একজন ভদ্রলোক বেশ কিছুটা ইতস্তত করে জানতে চাইলেন, "তোমরা এই কোয়াটার্সে অনেকদিন আছ? "
"না, তিন চার বছর হবে", আমি একটু অবাক হয়েই উত্তর দিলাম।
উনি ওনার পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে দেখিয়ে বললেন, "ইনি এই কোয়াটার্সে ছোটবেলায় থাকতেন।তাই একবার দেখতে এসেছেন। এখন ইনি ওয়াল্টেয়ারে থাকেন। ওনারা সাউথ ইন্ডিয়ান, অন্ধ্রের লোক।"
আমি ভদ্রলোককে আবার ভাল করে দেখলাম। না, অবাঙালীর তেমন কোন ভাব দেখলাম না। উনি হেসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর যথেষ্ট ভাল বাংলায় বললেন, "আমি কি একবার ভিতরে আসতে পারি? যদি তোমাদের কোনো অসুবিধা না থাকে?"
ভদ্রলোকের বলাটার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল আমি, "আসছি" বলে মায়ের অনুমতি নিতে ছুটলাম।
ওনারা ভিতরে এসে বসলেন। যে ঘরে আমি আর ভাই থাকতাম। খাটে বসেই বললেন, "আমাদের খাটটাও এরকমই পাতা ছিল, জানলার ধারে।"
ইতিমধ্যে বাবা এসে গেছেন। মায়ের চা করা হয়ে গেছে। ওনারা সবাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করছেন। আমি লক্ষ্য করছিলাম সাউথের ভদ্রলোক মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন আর ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, কি যেন খুঁজছেন।
এর মাঝে মা বললেন, "চলুন বাকি ঘর গুলো দেখে নিন। এত দূর থেকে আসা যার জন্য।"
ওনার মুখের ভাব কিরকম পাল্টে গেল। একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি তখন তোমার থেকে দু'এক বছরের ছোট। একদিন সন্ধ্যেবেলা খেলে ফিরেছি, বাবা ডাকলেন। আমিও এই ঘরেই শুতাম। ওই জানলার কাছে আমাকে নিয়ে বাবা বসলেন। তারপর আমায় বললেন মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আমার মাথায় বাজ পড়ার মত হল, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার মত। বাবা কাঁদছিলেন। আমি কাঠ হয়ে বসেছিলাম। মা তখন হাসপাতালে। শেষ দিনগুলো মায়ের এই বাড়িতেই কেটেছে। তারপর উনি চলে গেলেন। বাবা ট্রান্সফার নিয়ে ওয়াল্টেয়ারে চলে গেলেন আমাদের নিয়ে।"
বাড়ির পরিবেশ কেমন মন খারাপ করা হয়ে গেল। শুধু পাখার আওয়াজ আর ক্যালেন্ডার-এর দেওয়ালে ঘষা লাগার শব্দই শোনা যাচ্ছিল।উনি বলতে লাগলেন, "খুব ভাল মানুষ ছিলেন জানেন। আমার কয়েকদিন ধরে ওনার কথা খুব মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল এ বাড়িতে আসলে কোথাও যেন মায়ের ছোঁয়া পাব।" ওনার চোখ দুটো লাল হয়ে আসছিল। মায়ের চোখে জল। বাবা আর ওনার বন্ধু চুপ করে শুনছিলেন। ইতিমধ্যে আমার বন্ধু এসে কখন আমার পাশে বসেছে খেয়ালই করিনি।
উনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "যা হোক। আপনারা যে আমায় বাড়ির মধ্যে আসতে দিয়েছেন, এতটা সময় দিয়েছেন আমি কৃতজ্ঞ তার জন্য। আমি উঠি।"
আর বেশি কথা হল না। উনি যাওয়ার আগে শুধু রান্নাঘরটা দেখতে চেয়েছিলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর চলে গেলেন।
আমি আর আমার বন্ধু আর বেড়াতে বেরোলাম না। ভাল লাগছিল না। ও চলে যাওয়ার পর ইচ্ছে করে বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে গিয়েছিলাম মা কে দেখতে। কেন বলতে পারব না।মা-ও বুঝেছিলেন বোধহয়।
আজ এতদিন পর আমি ঐ ভদ্রলোককে অনুভব করতে পারি, কেন উনি ছুটে এসেছিলেন অতটা পথ পাড়ি দিয়ে মাকে খুঁজতে। আজ যখন রান্নাঘর কেন, বিশ্ব সংসারের কোনো ঘরে গেলেই যখন মাকে আর ছুঁতে পাব না, আজ বুঝি আমি।