Skip to main content

দুটো পা বেঞ্চির উপর তুলে বসে আছে রত্না। সবুজ সিল্কের শাড়িটার উপর মাথা রেখে। পেট ফেটে যাচ্ছে চাপে। এত জল খাইয়েছে। ফটো তোলা হবে পেটের। বাচ্চা এসেছে কিনা জানবে।

এসেছে, বাচ্চা।

=====

দীপক অফিস থেকে আসে। পা ধোয়। গোড়ালি বেয়ে ধুলো জল নর্দমায় চলে যায়। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে ঘরে বসে। টিভি চালায়। রত্না চেয়ারে বসে থাকে। পা দুটো তুলে বসে থাকে। কোমর থেকে টাটায়। মাথার ভিতর ভীমরুল কামড়ায়। দীপকের মা, কস্তুরী চা আর মুড়ি আনে। খাটে রাখে। দীপক মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। কস্তুরী ছেলের মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করে। চলে যায়। আড়চোখেও তাকায় না রত্নার দিকে। রত্না পা দুটো বুকের কাছে জড়ো করে আনে আরো। কস্তুরীর জটাওলা মাথা, বড় সিঁদুরের টিপ, পলার আওয়াজ মাথায় বাড়ি মারে।

=====

দীপক আর অলোক মায়ের কাছে শোয়। অলোক সারা বছর। রত্নার মাসিক শেষ হওয়ার পর থেকে দিন হিসাব করে, কস্তুরী হিসাব করে দেয়। তারপর বারো-পনেরো দিন পর কস্তুরী রত্নার যোনি দেখে। রত্নার সারাটা গা শিউরে ওঠে। আঙুল দিয়ে তাপ মাপে। হিসাবে মিললে দীপক শুতে আসে, সাতদিন।

অলোক বিয়ে করবে না। সে মায়ের আশীর্বাদ। শাড়ি পরে থাকে ধুতির মত। রাতদিন ঠাকুর ঘরে। কস্তুরীর শনি-মঙ্গলবার ভর পড়ে। প্রচণ্ড ভিড় হয়। দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসে। মাদুলি দেয়, শিকড় দেয়, জলপড়া দেয়। কস্তুরীর মাথার কাঁচাপাকা চুলও বিক্রি হয়, হাজার টাকায়। সব অলোক সামলায়। রাতে দীপক আর অলোক মাকে মাঝে রেখে শোয়। রত্না বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দীপকের নাক ডাকা শোনে। শুতে যায়। কখনও ননদের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। জানলায় টোকা দেয়। ননদ দরজা খোলে। খুলে বলে, তোমার ওখান থেকে পোকা বেরোচ্ছে?

=====

লক্ষ্মীর পেট হয়েছিল। যে পেট করেছিল সে ছিল পাগল। লক্ষ্মী ছাগল চরাতে যেত হারুদের পুকুরের ওদিকে। লোকে বলে হরেন ওকে ওখানে নষ্ট করেছিল। লক্ষ্মী বলে, ভালোবেসেছিল।

হরেনের মৃতদেহ পুকুর থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কেস নামমাত্র হয়েছিল। আজ অবধি কস্তুরীর দিকে আঙুল তুলে কেউ বংশরক্ষা করতে পারেনি। পুলিশ হলেও কি হবে, পরিবার তো আছে।

এ ঘটনা বছর পনেরো আগের। এখন লক্ষ্মীর পায়ে শিকল পরানো থাকে। একবেলা খায়। হাগে মোতে ওই ঘরে। কস্তুরী ওকে পিশাচ দিয়ে বশ করিয়ে রেখেছে। অমাবস্যার দিন, কি গ্রহণের দিন লক্ষ্মীর ঘরের সামনে পুজো পড়ে। লক্ষ্মীকে বেণারসী পরিয়ে সাজানো হয়। অলোক সাজায়। লক্ষ্মীকে আফিম দেওয়া থাকে। ভর হয় লক্ষ্মীর। কাঁসর-ঘন্টা বেজে ওঠে। রত্না ঘরে এসে দরজা দেয়। দীপকের পা জড়িয়ে কাঁদে। বলে, যেও না, আমার ভয় করছে।

দীপক যায়। মায়ের পাশে বসে। রত্না ঘুমিয়ে পড়ে।

=====

সারা ট্রেন কথা বলল না রত্না। দীপক বলল, চা খাবে? ছোলা খাবে? বাদাম খাবে?

রত্না চুপ করে থাকল। দীপক কিনল, রত্না হাত বাড়াল না। হাতে দিতে গেল। হাত মুঠো করে নিল। পা তুলে উবু হয়ে বসল।

দীপক বলল, এভাবে ট্রেনে পা তুলে বোসো না।

রত্না পা দুটো আরো জড়ো করে নিল। দীপক জানলার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

=====

কস্তুরী সারাদিন কথা বলে না। শুধুমাত্র ইঙ্গিত করে। দীপক বাড়ি ঢুকে মাকে প্রণাম করে যখন জানালো ডাক্তার বলেছে বাচ্চা এসেছে, কস্তুরী কিছু না বলে মায়ের মন্দিরে গেল। একটা ফুল নিয়ে এসে রত্নার মাথায়, পেটে ঠেকালো। রত্না মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

দীপক বলল, মাকে প্রণাম করো….

রত্না বলল, ডাক্তার ঝুঁকতে বারণ করেছেন, শোনোনি?

কস্তুরী রত্নার চোখের দিকে তাকালো। রত্না বহুদিন পর তাকালো। অপলক।

=====

দীপক কাজের জন্য সন্দেশখালি এসেছে। দু'দিন হল। থানা থেকে ফোনটা পেল অফিসে এসেই। বাড়ি যেতে কম করে তিনঘন্টা।

থানায় ঢুকল বিধ্বস্ত দীপক। যা যা আশঙ্কা করেছিল সারা রাস্তা সে সব ছবি মিলিয়ে এক ধুলোঝড়ের মত মাথাটা হয়ে আছে।

থানায় ঢুকেই দেখল রত্না বসে। উবু হয়ে। সারা শাড়ি আলতা…. না রক্ত। মুঠোয় ধরা নারায়ণ শিলা। রক্তাক্ত। লাল। মাথা নীচু করে বসে রত্না।

বাইরে ভ্যানে পোড়া শরীরটা অলোকের। দড়ি দিয়ে বাঁধা। গোটা গ্রাম ভিড় করে থানায়। পাশের ভ্যানে সাদা চাদরে মোড়া, মা?

লক্ষ্মীকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ঘর খোলা। শিকল মেঝেতে লুটিয়ে মড়া সাপের মত।

লক্ষ্মীকে পাওয়া গেল দু'দিন পর পুকুরে ফোলা শরীরটা ভেসে ওঠার পর। যে পুকুরে হরেনকে পাওয়া গিয়েছিল।

রত্না কোনো কথা বলেনি। বড়বাবু বলেছে, ও সব স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু কেন করলো জিজ্ঞাসা করলে বলছে, মা কালী আদেশ দিয়েছিল, তাই। রাতের খিচুড়িতে যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলে, কোথায় পেলে?

রত্না বলেছিল, মা স্বপ্নে দিয়ে গেছেন।