গোবিন্দ চক্কোত্তি এ পাড়ার কালী মন্দিরের পুরোহিত। ভীষণ নিষ্ঠা নিয়ে পুজো-আচ্চা করেন। সবাই বেশ শ্রদ্ধা করে। নির্লোভ মানুষ। শান্ত মানুষ। কিন্তু সেদিন পুরোদস্তুর ক্ষেপে উঠলেন। কেন? সেই গপ্পোই তো বলছি।
তিনি মায়ের আরতি করে, ভোগ দিয়ে শয়ান দিয়ে মন্দিরে তালা লাগিয়ে বেরোচ্ছেন, এমন সময় চোখে পড়ল মন্দিরের সামনেই অন্নপূর্ণা শাড়ির দোকানের বিজ্ঞাপন, বিশাল করে কাপড়ে লিখেটিখে, টাঙিয়ে দিয়েছে…. ”মা আসছেন"।
ব্যস, মাথাটা গরম হয়ে গেল। মা আসছেন মানে কি? তবে আমি কার পুজো করি সারা বছর? তোরাই বা কার পুজো দিতে আসিস মাসে, দুমাসে? যত্তসব গোলমেলে কথা! বলি পঁচিশে ডিসেম্বর কি ওরা লেখে যীশু আসছেন? চার্চে গিয়ে কি ওরা হেদিয়ে মরে, ওহে তুমি তো পিতার কাছে তিনশো চৌষট্টি দিন থাকো, এই একটা দিনই আসো আমাদের চার্চ আলো করে। মা তো চিরকালই আছেন। আসলে বলে দুর্গোৎসব আসছে, মা আসছেন কেন লিখছিস? লেখো উৎসব আসছে।
গোবিন্দবাবু রেগেমগে বাড়ি ঢুকেই শুনলেন আজই মেয়ে আর মা 'শপিং' এ যাবে। শপিং, প্যাণ্ডেল হপিং… কি বিরক্তিকর। এদিকে বিজয়ায় নো প্রণামিং, নো কারোর বাড়ি যায়িং। সেখানে সব ওই হোয়াটসঅ্যাপিং। রেডিমেড শুভেচ্ছা।
======
চোখের সামনে বউ আর মেয়ে অন্নপূর্ণা শাড়ির দোকানে ঢুকে গেল। মাথাটায় যেন তুবড়ি ফেটে গেল গোবিন্দবাবুর। ওই তো মালিক বসে। ব্যাটা বুড়ো হল, ঘটে কাণ্ডজ্ঞান জন্মালো না। সাচ্চা ধম্মকম্মো জন্মালো না। গোবিন্দবাবু দোকানের মালিকের সামনের টুলটায় বসলেন। দোকানে মোটামুটি ভিড়। লালটু নন্দী চশমাটার উপর দিয়ে দেখে, একগাল হেসে বললেন, আরে এ যে পুরুত মশায়… কি সৌভাগ্য আমার… ওরে চা এনে দে… চিনি ছাড়া কি?
না। চিনি দিয়েই। তো কথা হচ্ছে… মা আসছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ… এই তো মা আসছেন…. আর কদিন...... লালটু নন্দী চশমাটা খুলে পাশে তোশকে রেখে বলল।
তো কিসে আসছেন মা… বন্দে ভারতে? না চার্টাড ফ্লাইটে?
উফ, কি যে বলেন, পাঁজিতে কি যেন লিখেছে দোলায় না ঘোড়ায় কিসে যেন মা আসছেন…..
বুঝেছি।
গোবিন্দবাবুর কান চুলকাচ্ছে। নাক চুলকাচ্ছে। কি করবে? একটু নিজেকে শান্ত করে বললেন, তা চণ্ডীটা পড়া আছে?
উফ্ কি যে বলেন! ওসব সংস্কৃত কি বুঝি? বীরেনবাবু কি মহালয়ায় কি যে বলেন রেডিওতে তা-ই ছাই বুঝি না…. তবে হ্যাঁ আজকাল হনুমান চালিশাটা রোজ পড়ি…. বলব কি, দোকানের বিক্রি-বাট্টাও বেড়েছে তারপর থেকে। আমার কি মনে হয় জানেন পশ্চিমে ওরা এইসব করেই এত উন্নতি করেছে। ওদের ধম্মোটা সলিড বুঝলেন। ওসব সংস্কৃতর ধার ধারে না। আমাদের এই যে রামভরণ… আপনাকে গোটা রামচরিতমানস শুনিয়ে দেবে… দিব্যি হিন্দিতে… আর আমাদের ওসব সংস্কৃত-টিত…..
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গোবিন্দবাবু। চা এলো। চায়ে চুমুক দিলেন। কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে খান-চারেক বিলও কেটে ফেলল লালটু। পারেও। আর তার নিজের খান-দশেক পুজো এলেই গোত্র আর মন্ত্রে হিমশিম খেতে হয়। হিসাব আর ভক্তি বড় সাপে-নেউলে জিনিস বোধায়!
গোবিন্দবাবুর মাথাটা ঠাণ্ডা হল। দোকানের দেওয়ালে ঘড়ির পাশে টাঙানো মা ভবতারিণীর ছবি দেখিয়ে বললেন, মা তো তোমার সঙ্গে সারা বছরই আছে বাবা আমার…. তো ব্যানারে আবার "মা আসছেন" লিখেছ কেন? মানলাম আমাদের বাঙালিদের অমন একটা গপ্পো আছে… হিমালয় থেকে বাপের বাড়ি আসেন ইত্যাদি…. কিন্তু মা তো গপ্পো নয়… চণ্ডীতে আছে তিনি সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তি সমন্বিতে… মানে তিনি সর্বত্র…. সব সময়… রামপ্রসাদ গাননি? "মা বিরাজে সর্বঘটে"…. তাঁর কি আর আসা যাওয়া হয় গো…. তিনি তো আছেনই…. থাকবেনও…. তবে হ্যাঁ, বলতে পারো দুর্গোৎসব আসছে…. কিন্তু মা আসছেন কথাটার কি মানে হল? ক'টা মা আছে গো? তিনিই তো দক্ষিণেশ্বরে, কালীঘাটে, তারাপীঠে এইসব জায়গায় পুজো নিচ্ছেন না? সারা বছর? এত এত ভক্ত রাতদিন বিপদেআপদে, সুখেদুখে "মা মা" করে ডাকছে না? সেকি তিনি হিমালয়ে আছেন বলে, না সব সময় সর্বত্র জাগ্রত আছেন বলে… হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, সব সৃষ্টি জুড়ে তো তিনিই…. তার আবার আসা যাওয়া কি?
গোবিন্দবাবু থামলেন। চশমাটা খুলে ধুতির খুঁটে চোখটা মুছে আবার চশমাটা পরেই দেখেন এক দোকান বাচ্চা-বুড়ো-মহিলা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। কারোর কারোর চোখে জল চিকচিক করছে। ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলেন গোবিন্দবাবু… কি অবস্থা…. বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল… ছি ছি….. কিন্তু না বলেও তো থাকতে পারছিলেন না… একটা মিথ্যা লিখতে লিখতে, বলতে বলতে এমন অভ্যাস হয়ে যায় যে… তখন মনে হয় এটা বুঝি খুব সত্যি কথা একটা যা হোক…. কিন্তু তাই কি?
তিনি হাতজোড় করে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমায় ক্ষমা করবেন আপনারা আমার কথায় আঘাত পেয়ে থাকলে… আসলে দেখুন হয় আমাদের আস্থাবান হতে হবে, নয় নাস্তিক… দুটোই সাচ্চা… কিন্তু শুধু হুজুগে হলে তো কাজের কথা হয় না…. মা তো চিরকালের..... তাঁর কোনো আসা যাওয়া নেই…. আবাহন বিসর্জন প্রতিমার হয়.. শুরু শেষ… আসা যাওয়া.. উৎসবের হয়… জগন্মাতার হয় কি? ভাববেন একটু…
লালটু খুব চিন্তিত হয়ে বলল, কিন্তু এত টাকা দিয়ে ব্যানার ছাপিয়ে ফেলেছি… সব জায়গায় টাঙিয়ে ফেলেছি….
গোবিন্দবাবুর লালটুর পিঠে হাত দিয়ে বললেন, আহা পরের বছর বদলে নিও না হয়…. মা আসছেন না লিখে…. পুজো আসছে লিখে দিও….
=========
গোবিন্দবাবুর স্ত্রী সারারাস্তা কথা বললেন না। মেয়ে মোবাইল ঘাঁটতে ব্যস্ত। তাই থাকে সব সময়। গোবিন্দবাবু বললেন, চলো মায়ের মন্দির ঘুরে যাই একবার।
রত্না বলল, এই তো বললে তিনি সব জায়গায়, এখান থেকেও তো প্রণাম করলে হয়….
গোবিন্দবাবু বললেন, তাও হয়…. তবে সেখানে
গেলেও হয়… যেমন গঙ্গায় যেখানে সেখানে নামলেই গঙ্গায় নামা হয়… তবে বাঁধানো ঘাট হলে সুবিধা হয়…. তেমন আরকি……
(ছবি Suman)