Skip to main content

ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, সেটা খুব সম্ভবত পঞ্চমীর দিন ছিল। বেশ রাত হয়ে গেছে। আমি ভাই আর বোনকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঢুকেছি। এমন সাজ আমি এরপরে আর কোনোদিন দেখিনি, কালীমূর্তিকে একটা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরানো, সব গয়না খোলা, দু'জন মিলে হাত পা মোছাচ্ছে। ঠিক যেন বাড়ির মা, সারাদিনের ধকলের পর গা ধুয়ে বসার ঘরে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছেন। মুখের অপরূপ হাসি, ভক্তের জগৎজননী – আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, আবদার।
       আমি নাটমন্দিরে বসলাম। আকাশ ভর্তি তারা। বালিব্রীজ কাঁপিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার আওয়াজ। দূরে দূরে মাইকের আওয়াজ, নানা প্যাণ্ডেলের থেকে অবশ্যই। সেই মুহূর্তে আমার চিন্তা ঘিরে একটাই শব্দ – মা।
       এর অনেক পরে, আই সি ইউ -এর দু'নম্বর বেডে, যিনি অন্তিম শয্যায়, তিনি আমার মা। ঘোরের মধ্যে। আমি পাশে বসে, তাকালেও চিনতে পারছেন না। আমার সমস্ত কিছু শূন্যের দিকে এগোচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি। সেদিন কোনো এক মুহূর্তে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই দক্ষিণেশ্বরের সেদিনের রাতের টুকরো ছবিটুকু, মা।
       এই দুই ঘটনার মাঝের ঘটনা, মায়ের অসুস্থতা সদ্য ধরা পড়েছে। চলাফেরায় বিধিনিষেধের গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসা মা দেখছেন, সাগ্রহে বরণ করছেন তাদের, কারণ তিনি যে ক'দিন থাকবেন সেই ক'দিনই নিজের হাতে গড়া সংসারটাকে খাদের পড়ার হাত থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। তাই এত বেশী করে চাওয়া, রোগের অগ্রসর হওয়াকে যেন ঠেকিয়ে রাখা যায়।
       আমার মনে হল আমায় একটা দু'চাকা অন্তত কিনতে হবে, যাতে মা-কে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়ানো যায়। অনেকে নানা বাইকের মডেল দেখালো, মনে ধরল না। যেরকম বাইকে পুরুষত্ব ফুলে ফেঁপে ওঠে, সেরকম নানা বাইকের সাজেশান। আসলে পুরুষত্বটা বরাবরই ভীষণ একটা নির্ভরশীল বস্তু, কোনোকিছুকে অবলম্বন না করে যেন সে তার প্রয়োগের রাস্তাটা ঠাহর করতে পারে না। আমি বাইকের দোকানে গিয়ে দেখতে শুরু করলাম কোনটাতে মায়ের চড়তে সুবিধা হবে। সিটটা বেশ চওড়া হওয়া চাই, নীচু হওয়া চাই। পছন্দ হল 'প্লেজার' বলে একটা স্কুটি। হ্যাঁ, স্কুটি। অনেকের এমন 'মেয়েদের' মত গাড়ি কেনাটা পছন্দ হল না। তখন স্কুটিটা আসলে সদ্য ঢুকছে। আজকে যেমন ছেলে কি মেয়ে চালালো সেটা তেমন কোনো বড় কথা না, সেদিন তেমনটা ছিল না। তবে আমার এই স্কুটি কেনাটায় আমার পৌরুষের তেজকে কতটা খাটো করেছিল বলতে পারি না, মা প্রচণ্ড খুশী হয়েছিলেন।
       এরপর শুরু হল মা-কে নিয়ে বিকালবেলা, সন্ধ্যাবেলা, সকালবেলা --- যেমন যেমন সময় পাওয়া যায়, তেমন তেমন অভিযানে বেরোনো। ডিকি'র মধ্যে ওষুধ, গ্লুকোজ, চামচ, গেলাস। মা জানতেন না যদিও এগুলোর কথা, এসব তো আমার মনোবল বাড়ানোর জন্যেই কেবল নেওয়া। যদিও লাগেনি একদিনও। মা-কে নিয়ে কাঁচরাপাড়া বাজারে যেতাম, মা মার্কেটিং করতে পছন্দ করতেন খুব। মা-কে কোনো দোকানে বসিয়ে, পাশে স্কুটিটাকে স্ট্যান্ড করে, ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে দূরে অপেক্ষা করতাম। আসলে বোঝাতে চাইতাম যেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থই মানুষ, এতটা নজরদারিতে থাকার কিছু দরকার নেই। দেখতাম মা দোকানের টুলের উপর বসে, ভিড়ের মধ্যে মিশে অলক্ষ্যে লক্ষ্য করতাম, পিছন ফিরে ঝুঁকে কিছু একটা দেখছেন। স্কুটিটা পাশে স্ট্যাণ্ড করানো, আমি, মা আর স্কুটিটা – এ যেন একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব।
       বসন্তের বিকালে রেলকলোনীর রাস্তায় মা-কে নিয়ে বেড়াতে যেতাম। বড় বড় গাছ, দারুণ সব ফুল ফুটে আছে, ফাঁকা ফাঁকা বড় বড় রাস্তা, দক্ষিণের বাতাস --- সে একটা মায়াময় পরিবেশ। মা গল্প করতেন, অনেক অনেক গল্প। যে গল্পগুলো বলার কোনো কারণ নেই, কিন্তু বারবার বলতে ভালো লাগে। উপদেশ নয়, ক্ষোভ নয়, অভিযোগ নয়, বাসনা নয় --- স্মৃতির ঝাঁপি জুড়ে থাকা শুধুই নির্মল আনন্দে ডোবা মুহূর্তগুলোর কথা --- আলপনার মত। মানুষের মনের মধ্যে যদি এমন আলপনা আঁকা না থাকে, অন্তত কিছুটা বারান্দা জুড়ে, তবে সে নিজেকে নিয়ে তুষ্ট থাকে কি করে? মা তুষ্ট ছিলেন। হিসাব মিলেছিল বলে না, হিসাবের খাতা হারিয়েছিল বলে। মায়ের হিসাবে বিয়োগ যা হত, তা গোঁজামিলের যোগে ঠিক মিলে যেত, মানে মনে মা মিলিয়ে নিতেন। তেমন গোঁজামিল দেওয়ার সামগ্রী লক্ষ্মীর থেকে নারায়ণ দিয়েছিলেন যেন বেশী, একটা ভালোবাসা টইটম্বুর হৃদয়।
       এরপর ধীরে ধীরে আমি আর আমার স্কুটি একা হয়ে গেলাম। মায়ের বসার ক্ষমতা হারালো। আমি তখন মাকে নিয়ে না, মায়ের কাজের জন্য সারা জগত যেন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম সেই স্কুটি নিয়ে। ওষুধের দোকান, মুদির দোকান থেকে হাস্পাতাল। আসলে যাই করি না কেন, যে কাজে মা খুশী সেই কাজটাই আমার চূড়ান্ত সার্থক, এমন একটা সুখের সহজ মানদণ্ড ছিল আমার। তাই সারাদিন ঘুরে ফিরে মায়ের কাজের মধ্যেই আমার চূড়ান্ত সুখ তখন।
       অবশেষে শেষ এল। হল কি, আমি আর স্কুটিটাতে উঠতে পারলাম না। আমি চালালেই হয় পথ হারাতাম, নয় আমার পিছনের আরোহীকে হারাতাম। তিনি যে রথের আরোহী তখন আমার যে সময় হয়নি সে রথে চড়ার। মাঝেমধ্যে সেই রেলকলোনীর রাস্তা, অন্য রোগী শোয়া রেলের হাস্পাতালের আই সি ইউ -এর দু'নম্বর বেড, সব সেই স্কুটি চড়ে আবার আবার দেখতে গিয়েছি। কিন্তু দু'জনেই দু'জনের থেকে মুখ ফিরিয়ে এসেছি। পাঠক হয় তো ভাবছেন, একটা যন্ত্র এতটা জীবন্ত হয়? হয়। মানুষ জড়কে জীবন্ত করে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতাতেই তো। নইলে ওইটুকু পাথরের মূর্তিতে জগন্মাতাকে দেখে কি করে ভক্ত? ভক্তের ভালোবাসায় সে পাথর তার সীমা হারায়, অসীম হয়ে ওঠে।
       স্কুটি থাকল না আমার সাথে আর। তাকে ছুটি দিলাম। আজও যখন মন কোনো কারণে ঘুরে-ফিরে সেই দু'নম্বর বেডের কাছে গিয়ে বসে, আমি দেখি মায়ের আশ্রয়টা হারায়নি তো। যখন জ্বর গায়ে কোনো বন্ধু কপালে হাত রাখে, একটা বাচ্চা এগিয়ে এসে শরীরের খোঁজ নেয়, হঠাৎ আকাশটা বড্ড আপন হয়ে ধরাছোঁয়া যায় এমন আত্মীয়ের মত লাগে, সকালের রোদটা চাদরের উপর এসে পড়ে, স্নানের জল শরীরের সাথে মিশে ক্লান্তি দূর করে নামে, রাতের অন্ধকারে চলতে চলতে কিভাবে কিভাবে যেন নিজেকে আর একা একা লাগে না, বুকের ভিতর থেকে কেউ বলে, আছি তো, সব ঠিক আছে – সেই শান্তিকে কি বলে? মা।
       কেন এসব কথায় ডুবলাম আজ? আমার খুব কাছের একজন মানুষ, আমার প্রাক্তন ছাত্র তথা আজকের বন্ধু স্কুটি কিনতে গেল। আমায় বলল, তৈরি থেকো, তোমায় চড়াব প্রথম। তাই হল। সে যখন নতুন স্কুটি নিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ির সামনের উঠোনে এসে দাঁড়ালো, আমার সেই মেঘলা দুপুরের কথা মনে এল, মা প্রসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে দরজাটা ধরে, আমি ঢুকছি গাড়িটা নিয়ে, নানা বিধিনিষেধের মধ্যে খোলা আকাশ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, যে ক'টা দিন বাকি আছে মায়ের, তারই মধ্যে থেকে চুরি করে।
       আমি ঘুরে এলাম। সেই কাঁচরাপাড়ার বাজার, সেই রেলকলোনীর রাস্তা, সেই ধানক্ষেত। আমার বন্ধু বলল, তুমি চালাও। আমি বললাম, থাক। ঝাপসা চোখ আমার, এই চোখে গাড়ি চালানো যায়? তাকে বললাম না সে কথা, বললাম "পরে"।
       ফিরতে ফিরতে যে কথাগুলো বুকের মধ্যে চাপ হয়ে জমে, তাকে জন্ম দিচ্ছে কে? আমার মাতৃভাষা। মায়ের ভাষা। তাই বলছিলাম না, মাকে হারিয়েও এক জগতজোড়া মাতৃত্বের আভাস পেয়েইছি। এ বিশ্বসংসার এক চৈতন্যের আঁচলে মোড়া নাকি। আমি বিশ্বাস করি। সমস্ত ধ্বংসলীলার মধ্যেও এই যে প্রাণের জয়তোরণ, এই যে নিজেকে রক্ষা করে চলা সাথে সাথে চারপাশকে রক্ষা করে চলার যে নির্দেশ মানুষের চেতনায়, সে কার চেতনার সমান্তরালে? অবশ্যই সেই চেতনা মা, যা রক্ষা করে চলে। এত বিষাদ, এত অবসাদ, এত বিকৃতি, এত ক্ষোভ, দুরাশার ছোবল --- এ সবের মূলে মানুষের যেন একটাই ভুল - নিজেকে রক্ষা করার চেতনাকে অস্বীকার করা। সে চেতনা কোনো জটিল সমীকরণ নয়, সে শান্ত প্রিয় আলোকিত চেতনা মানুষের। অস্তি ভাতি প্রিয় - যাকে সাধক বলে। স্কুটির চালক বিজ্ঞান হোক, কার্য-কারণ সূত্রের খোঁজ চলুক, কিন্তু আরোহী যেন মা হন, যে সমস্ত কার্যকারণ সূত্রের মূল সুর - চেতনা, যা রক্ষা করে, যা মা।